Friday 5 February 2016

হাফেজ ইবরাহিমঃ আরবি ভাষার আর্তনাদ


আরবি ভাষার আর্তনাদ

মূল- হ়াফ়েজ় ইব্‌রাহিম, মিশর

অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

 

আমি মনে মনে অনেক চিন্তাভাবনা করলাম।

তারপর নিজেকে দোষারোপ করলাম

মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে দেখে আমি আওয়াজ দিলাম

নিজ সম্প্রদায়ের লোকেদেরকে 

কিন্তু তারা আমায় বন্ধ্যা বলে দূরে সরিয়ে দিল

তখনও আমি ভরা-যৌবনে;

যদি আমি সত্যিই বন্ধ্যা হতাম

শত্রুদের অমন কথায় ঘাবড়ে যেতাম না

আমি জন্ম দিয়েছি বহু কন্যা সন্তান

কিন্তু যখন উপযুক্ত পাত্র পাইনি

জ্যান্ত পুঁতে দিয়েছি সেই কন্যাদের।

 

আমি তো পরিব্যাপ্ত করেছি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনকে

ভাব ও ভাষায়, আমি তার আয়াত ও উপদেশ প্রকাশে

বিন্দুমাত্র অপারগ হয়নি; তাহলে কোনও যন্ত্রের বিবরণে

কীভাবে আজ সংকীর্ণ হবো আমি ?   

কীভাবে অপারগ হবো কোনও আবিষ্কারের নামকরণে ?

আমি একমহাসমুদ্র, আমার গভীরে

 লুকিয়ে আছে অসংখ্য মণি-মুক্ত

ডুবুরীদের কাছে তারা কি খোঁজ নিয়েছে কখনও  

আমার ঝিনুকের, আমার মুক্তোর!

 

তোমরা কোথায়, কোন্‌ দিশায় ছুটে চলেছ?

আমি যে এখন জীর্ণ, আমার সৌন্দর্য আজ

বিলীন হওয়ার পথে; পথ্যের এই আকাল-সময়ে

তোমরাই আমার চিকিৎসক, তোমরাই আমার পথ্য

তোমরা আমায় সঁপে দিওনা যুগের কাছে 

ভয় হয়, পাছে হারিয়ে যাই সময়ের করালগ্রাসে

পশ্চিমারা আজ বরেণ্য সমগ্র মানচিত্র জুড়ে

তাঁদের ভাষা জয় করেছে পুরো পৃথিবী

তারা স্বজাতির নিকট নিয়ে এসেছে নিত্যনতুন আবিষ্কার

হায়, তোমরা যদি গুটি কয়েক শব্দ নিয়ে আসতে!  

পাশ্চাত্যের যে কাক আমাকে ভরা-যৌবনে

সমাধিস্থ করার দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে

তার সেই চিৎকার কি তোমাদের পুলকিত করে

পাখী উড়িয়ে যদি কোনোদিন শুভ অশুভ নির্ণয় করো

জানতে পারবে পর্দার ওপারে থাকা

তাদের অসংখ্য ত্রুটিযুক্ত ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারাগুলি।

 

হে আল্লাহ্‌, তুমি তাঁদের কবরকে সিক্ত করো

জীবন দিয়ে যারা দূর করেছে আমার দৈন্যতা

তারা আজীবন, এমনকি জীর্ণ অবস্থাতেও

আগলে রেখেছিল আমার ভালোবাসা

তাই আমিও আগলে রেখেছি এই ব্যথিত হৃদয়-গহীনে

তাঁদের স্মৃতি, তাঁদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা

একদা তাঁদের সাহায্যেই আমি পরাজিত করেছিলাম

পশ্চিমাদের যখন সমগ্র প্রাচ্য মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল

কিন্তু বর্তমানে আমি প্রত্যহ লক্ষ্য করছি

পত্রপত্রিকায়, লেখনে-ভাষণে অসংখ্য ভুলত্রুটি

তাদের এই অযত্ন, এই অবহেলা ক্রমে ক্রমে

আমায় ঠেলে দিচ্ছে কবরের মুখে।

মিশরের নানা প্রান্তে লেখকদের দল চিৎকার করছে

আমি শুনতে পাচ্ছি তাদের চিৎকার, বুঝতে পারছি   

তাদের সেই চিৎকার আমার মৃত্যু সংবাদ বহন করছে

হায় আল্লাহ্‌! আমার জাতি কি আমাকে ছেড়ে

গ্রহণ করবে এমন এক ভাষাকে, যার বর্ণনাকারীরা দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন   

তারা কি বুঝতে পারে না, ওই অনারবদের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি 

আজ প্রবেশ করেছে আমার শিরা-উপশিরায়

যেমনভাবে ফোরাতের জলে মিশে যায় বিষধর সাপের লালা

তারা কি ভেবে দেখে না, আজ আমার দেহখানি

যেন একটা ছেঁড়াফাটা কাপড়, যাতে যুক্ত রয়েছে  

নানা রং ও আকৃতির সত্তরটি তালি।

আজ লেখক সমাজে যখন সমবেত হয়েছে

আমি তাদের নিকট আমার অভিযোগ ব্যক্ত করছি

এবং তাদের সম্মুখে আমার আশার আঁচল মেলে ধরেছি;   

এরপরে, হয় আমি ফিরে পাবো এক নতুন জীবন

যে জীবন আমার যাবতীয় জীর্ণতা দূর করে

সমাধির ভেতর থেকে খুঁড়ে বার করবে আমাকে

এবং প্রাণবন্ত করে তুলবে আমার অবয়বকে।

নয়তো বা এমন এক মৃত্যু গ্রাস করবে আমাকে

যার পরে প্রলয় বলে আর কিছু থাকবে না  

তোমার দিব্যি দিয়ে বলছি, সেই মৃত্যু এত ভয়ানক হবে  

যে অন্য কোনো মৃত্যুর সাথে তার তুলনা করা যাবে না।



عن حال اللغة العربية

حافظ إبراهيم
 

رَجَعتُ لِنَفسي فَاتَّهَمتُ حَصاتي          وَنادَيتُ قَومي فَاحتَسَبتُ حَياتي

رَمَوني بِعُقمٍ في الشَبابِ وَلَيتَني          عَقِمتُ فَلَم أَجزَع لِقَولِ عُداتي

وَلَدتُ وَلَمّا لَم أَجِد لِعَرائِسي              رِجالاً وَأَكفاءً وَأَدْتُ بَناتي

وَسِعْتُ كِتابَ اللَهِ لَفظاً وَغايَةً             وَما ضِقْتُ عَن آيٍ بِهِ وَعِظاتِ

فَكَيفَ أَضيقُ اليَومَ عَن وَصفِ آلَةٍ       وَتَنسيقِ أَسْماءٍ لِمُختَرَعاتِ

أَنا البَحرُ في أَحشائِهِ الدُرُّ كامِنٌ         فَهَل سَأَلوا الغَوّاصَ عَن صَدَفاتي

فَيا وَيحَكُم أَبلى وَتَبلى مَحاسِني          وَمِنكُم وَإِن عَزَّ الدَواءُ أَساتي

فَلا تَكِلوني لِلزَمانِ فَإِنَّني                 أَخافُ عَلَيكُم أَن تَحِينَ وَفاتي

أَرى لِرِجالِ الغَرْبِ عِزّاً وَمَنعَةً            وَكَم عَزَّ أَقوامٌ بِعِزِّ لُغاتِ

أَتَوا أَهلَهُم بِالمُعجِزاتِ تَفَنُّناً               فَيا لَيتَكُم تَأتونَ بِالكَلِماتِ

أَيُطرِبُكُم مِن جانِبِ الغَرْبِ ناعِبٌ         يُنادي بِوَأْدِي في رَبيعِ حَياتي

وَلَو تَزجُرونَ الطَيرَ يَوماً عَلِمتُمُ           بِما تَحتَهُ مِن عَثْرَةٍ وَشَتاتِ

سَقى اللَهُ في بَطنِ الجَزيرَةِ أَعظُماً         يَعِزُّ عَلَيها أَن تَلينَ قَناتي

حَفِظنَ وِدادي في البِلى وَحَفِظتُهُ          لَهُنَّ بِقَلبٍ دائِمِ الحَسَراتِ

وَفاخَرتُ أَهلَ الغَرْبِ وَالشَرْقُ مُطرِقٌ      حَياءً بِتِلكَ الأَعظُمِ النَخِراتِ

أَرى كُلَّ يَومٍ بِالجَرائِدِ مَزلَقاً               مِنَ القَبرِ يُدنيني بِغَيرِ أَناةِ

وَأَسْمَعُ لِلكُتّابِ في مِصْرَ ضَجَّةً          فَأَعلَمُ أَنَّ الصائِحينَ نُعاتي

أَيَهجُرُني قَومي عَفا اللَهُ عَنهُمُ            إِلى لُغَةٍ لَم تَتَّصِلِ بِرُواةِ

سَرَت لوثَةُ الإِفرِنجِ فيها كَما سَرى        لُعَابُ الأَفاعي في مَسيلِ فُراتِ

فَجاءَت كَثَوبٍ ضَمَّ سَبعينَ رُقعَةً         مُشَكَّلَةَ الأَلوانِ مُختَلِفاتِ

إِلى مَعشَرِ الكُتّابِ وَالجَمعُ حافِلٌ         بَسَطتُ رَجائي بَعدَ بَسطِ شَكاتي

فَإِمّا حَياةٌ تَبعَثُ المَيْتَ في البِلَى         وَتُنبِتُ في تِلكَ الرُموسِ رُفاتي

وَإِمّا مَماتٌ لا قِيامَةَ بَعدَهُ                مَماتٌ لَعَمري لَم يُقَس بِمَماتِ



 কবিতাটির সরল অনুবাদ—  

আমি মনে মনে চিন্তা করলাম। অতঃপর নিজের বিবেককেই অপবাদ দিলাম। আর আমার সম্প্রদায়কে আহ্বান করলাম এবং নিজের জীবনক্ষন গণনা করলাম।

আমার জীবনবসন্তে অর্থাৎ যৌবনকালে তারা আমাকে বন্ধ্যত্বের অপবাদ দিয়েছে। যদি আমি (প্রকৃতপক্ষে) বন্ধ্যা হতাম, তাহলে আমার সেই শত্রুসকলের কথায় ঘাবড়ে যেতাম না।

আমি জন্ম দিয়েছি। আর যখন আমার কন্যাসমূহের জন্য সুপুরুষ ও উপযুক্ত পাত্র পাইনি, নিজ কন্যাদের আমি জীবন্ত প্রোথিত করেছি।  

আমি আল্লাহ্‌র কিতাব আল-কুরআনকে ভাব ও ভাষা উভয় দিক থেকে পরিব্যাপ্ত করেছি। তার কোনও আয়াত ও উপদেশ প্রকাশে আমি অপারগ হয়নি।

তাহলে আজ বা বর্তমানে কীভাবে আমি কোনও যন্ত্রকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এবং আবিষ্কারসমূহের নামকরণের ক্ষেত্রে অক্ষম হতে পারি।

আমি সমুদ্র। আমার গভীরে মুক্ত লুকিয়ে আছে। তারা কি আমার ঝিনুক সম্পর্কে ডুবুরীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

তোমরা ধ্বংস হও, আমি জীর্ণ হয়ে পড়ছি, আমার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং এর ওষুধও দুর্লভ; তাই তোমাদেরকেই আমার চিকিৎসা করতে হবে।

তোমরা আমাকে যুগের কাছে সঁপে দিওনা। কেননা আমি আশঙ্কা করছি যে আমার মৃত্যু নিকটবর্তী হয়ে পড়ছে।

আমি পশ্চিমাদের জন্য সম্মান ও জয় লক্ষ করছি। তাছাড়া বহু জাতি তার ভাষার সম্মানিত হওয়ায় সম্মানিত হয়েছে।

তারা স্বজাতির নিকট নিত্য নতুন আবিষ্কার নিয়ে এসেছে। হায়, তোমরা যদি গুটি কয়েক শব্দও নিয়ে আসতে।

তোমাদেরকে কি পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে এমন এক দুঃসংবাদদাতা আনন্দিত করেছে, যে আমার বসন্তে অর্থাৎ যৌবনে আমাকে সমাধিস্থ করার আহ্বান জানাচ্ছে।

কোনোদিন যদি তোমরা পাখী উড়িয়ে শুভ-অশুভ নির্ণয় কর, তাহলে তার পেছনে কী ধরণের ত্রুটি ও বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা আছে তা জানতে পারবে। 

আল্লাহ্‌ (আরব) উপদ্বীপের গভীরে (শায়িত) এমন হাড়গুলিকে সিক্ত করুক, আমার অবয়বের দুর্বল হওয়া যাদের নিকট অতি কষ্টকর একটি বিষয়।

তারা জীর্ণতাতেও আমার ভালোবাসাকে আগলে রেখেছিল। আর আমিও তাদের জন্য সর্বদা ব্যথিত এক হৃদয়ে ভালোবাসাকে আগলে রেখেছি।

আমি পাশ্চাত্যবাসীদেরকে গর্বে পরাজিত করেছি এমত অবস্থায় যে প্রাচ্য মাথা নীচু করে রেখেছিল সেই জীর্ণ হাড়গুলির সাহায্যে।

আমি প্রত্যহ পত্রিকায় ভুলত্রুটি লক্ষ করছি, যা আমাকে কাল বিলম্ব না করেই কবরের নিকটবর্তী করছে।

আমি মিশরে লেখকদের চিৎকার শুনছি। জেনে রেখো, এই চিৎকারকারীরাই আমার মৃত্যুর সংবাদদাতা।

আমার জাতি কি আমাকে ছেড়ে আল্লাহ্‌ তাদের ক্ষমা করুক  এমন এক ভাষাকে গ্রহণ করবে, যার বর্ণনাকারীরা বিচ্ছিন্ন, মিলিত নয়।

ফিরিঙ্গী বা অনারবদের ত্রুটিগুলি এই আরবি ভাষায় প্রবেশ করেছে, যেমনভাবে ফোরাতের জলপ্রবাহে বিষধর সাপের লালা মিশে গেছে।

অতঃপর আরবি ভাষা এমন এক কাপড়ের ন্যায় হয়ে গেছে, যেটি নানা রং ও আকৃতির সত্তরটি তালি যুক্ত।

লেখক সমাজের নিকট এমত অবস্থায় যে তারা সকলেই সমবেত আমি আমার অভিযোগ ব্যক্ত করার পর আমার আশা প্রকাশ করেছি।

(এরপরে) হয় এমন এক জীবন (ফিরে পাবো), যা জীর্ণতাতেও মৃতকে পুনর্জীবিত করে তুলবে এবং সেই সমাধিগুলিতে আমার অবয়বকে প্রাণবন্ত করে তুলবে।

নয়তো এমন মৃত্যু (হবে আমার), যার পরে আর কোনও প্রলয় নেই। তোমার জীবনের শপথ, তা এমন এক মৃত্যু যে অন্য কোনো মৃত্যুর সঙ্গে তার তুলনা করা চলে না

No comments:

Post a Comment