Monday 18 February 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সেই দিনগুলি




 উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সেই দিনগুলি 

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

২০১৩-র জুন। আমি তখন স্নাতকোত্তরে পাঠরত। থাকি কারমাইকেল হস্টেলে। বাড়ি থেকে দাদা ফোনে জানালো, মিরাজুলের ছেলে হয়েছে, ২৫ দিন হল। কিন্তু প্রি-ম্যাচিওর বেবি। মালদার ডাক্তার পিজিতে রেফার করেছে। সঙ্গে মিরাজুল, নাজমা ও আমিরুল অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসছে। পরের দিন আনিসুর দা সব ফর্মালিটি মেনে ভর্তি করিয়ে দিল।

মিরাজুলের ছুটি শেষ। এবার তাঁকে ফিরতে হবে কাজে। তখন ওর পোস্টিং কাশ্মীরে। তিন দিন থেকে, বাড়ি হয়ে রওয়ানা দিল কাশ্মীরের পথে। আমি রোজ ক্যাম্পাসে ক্লাস করে বিকেলে ছুটে যেতাম পিজিতে। নাজমার সাথে কথা বলে, বাবুটার খোঁজখবর নিয়ে ফিরতাম। কোন প্রয়োজন হলে সেটা করতাম।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাশ্মীর যাত্রার দুদিন আগে সেনা কনভয়ে সন্ত্রাসীদের আক্রমণে শহীদ হয়েছেন আটজন জওয়ান। ২৪শের (সম্ভবত) সন্ধ্যায় খবরটা দেখলাম। খবরটা শুনে ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। রাত কেটে গেল। সকালে বাড়িতে কথা বললাম, সবাই কুশলে, সবাই বাবুটা কেমন আছে তা-ই জিজ্ঞেস করছে। বিকেলে ক্লাস করে পিজি যাব, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, বড়দা কল করেছে। রিসিভ করে কানে ধরেছি মোবাইলটা, অমনি বড়দার চাপাকান্নার স্বর আমার শ্রবণকে ছুঁয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে বলো। মিথ্যে বলল, কিছু হয়নি। শুনে আশ্বস্ত হতে পারলাম না। আরও দুএকজনকে ফোন করলাম। শেষে আমিরুল বলল সত্যিটা- কাশ্মীরে যে সেনা কনভয়ে জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে, মিরাজুলও ছিল সেই কনভয়ে। তাঁর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনও অফ। সবাই খুব দুশ্চিন্তায় আছে...।

বুকের ভেতরে আশংকার সকল মেঘকে চাপা দিয়ে হাসি মুখে পিজিতে হাজির হলাম। নাজমার সাথে কথা বললাম। বাবুটার স্বাস্থের কেমন উন্নতি হয়েছে, আনিসুর দার কাছে সব শুনলাম। একবারের জন্যও নাজমাকে বুঝতে দেয়নি আমার ভেতরে বয়ে চলা আশংকার সাইক্লোনটার কথা। সত্যিই অভিনয় করা যে কত কঠিন কাজ, খানিকটা সেদিন টের পেয়েছিলাম।

রাতে ফিরে কনফার্ম খবর পেলাম, মিরাজুলও সেই কনভয়ে ছিল। তাঁর পাশে বসা বাঁকুড়ার তাঁর সহকর্মীটি আর নেই। মিরাজুলকেও দুটি গুলি লেগেছে; তলপেটে। এখন জম্মুতে হাস্পাতালে ভর্তি। অবস্থা আশঙ্কাজনক। জেলা প্রশাসন বাড়িতে সে-খবর পাঠিয়েছে।

সন্তান পিজিতে সিরিয়াস কন্ডিশনে। বাবা জম্মুতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। রোজ বিকেলে আমি পিজিতে যাচ্ছি, নাজমার সাথে কথা বলছি। শুনছি। সব কথার শেষে ওর একটাই প্রশ্ন, ‘মামা, আপনার ভাগ্নার ফোন লাগছে না। তখনো সে জানে না কাশ্মীরে কী ঘটেছে। চতুর্থ দিন দুপুরে হোটেলে খেতে গিয়ে প্রথম জানতে পারে, কাশ্মীরে সেনাদের কনভয়ে আক্রমণ করেছে জঙ্গিরা। আটজন সেনা শহীদ হয়েছে। ভাত ফেলে ছুটে এসেছে হাসপাতাল চত্বরে। ততক্ষণে ওর মাথায় আশঙ্কা ও ইকুয়েশনগুলোর সাথে একটা কথা মাথায় কিলবিল করতে আরম্ভ করেছে, চারদিন হল সে ফোনে পাচ্ছে না মিরাজুলকে।

সেদিন বিকেলে আর মিথ্যা বলতে পারিনি। ছমাস লেগেছিল মিরাজুলকে সুস্থ হতে। এয়ারপোর্টে যেদিন ওকে রিসিভ করতে গেছিলাম, এক এক করে কত স্মৃতি মনের আকাশে ভেসে উঠছিল।

মাঝে, বাবুটা সুস্থ হল। ছুটি পেয়ে ওদেরকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আকিকা (নামকরণের অনুষ্ঠান) করা হল। বয়ে যাওয়া ঝড় ও পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ওর নাম রাখলাম নুমায়ের’ (চিতা)। যাতে ওর ক্ষিপ্র গতি ওকে অপরাজেয় করে, যাতে ওকে কোনোদিন ছুঁতে না পারে কোন জঙ্গির স্নাইপার, এই আশায়!

গতকালের পুলওয়ামার বিষাদ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল পাঁচ বছর পূর্বে, ২০১৩-র ২৪শে জুনের হায়দারপুরায়। মাঝে বদলে গেছে কত কিছু, দেশে, রাজ্যে, পুরো পৃথিবীতে। বদলেছে ক্ষমতা। বদলেছে সরকার। শুধু বদলায়নি সেনাদের দুর্দশার চিত্রটা!

১৫-০২-২০১৯
কলকাতা

No comments:

Post a Comment