Thursday 28 February 2019

হিফ্‌যখানায় কিছুদিন


 মাদ্‌রাসার সেই দিনগুলি...! 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

হিফ্‌যখানায় কিছুদিন
পরের দিন সকাল সকাল জাহাঙ্গীর আমাকে নিয়ে গেল অফিসে। সাথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস। ভর্তি হতে গিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিলদ্বিতীয় দিন যখন অফিসে গেলাম, কর্তৃপক্ষ জানালো, সব আসন পূর্ণ হয়ে গেছে। আর কোনো নতুন এডমিশন হবে না। তারপর এক সপ্তাহ লাগাতার অফিস যেতে থাকলাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। অবশেষে শলাপরামর্শ করে, ভর্তি হলাম হিফ্‌য বিভাগে। এই বিভাগে ছাত্রদের অল্প অল্প করে পুরো কুরআন হিফ্‌য (মুখস্থ) করানো হয়। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে ব্যাগপত্র নিয়ে গিয়ে উঠলাম ‘হিফ্‌যখানা’ বিল্ডিঙে। আদতে সেটা ছিল একটি মসজিদ।  ক্যাম্পাসে জামে মসজিদ নির্মাণের পর সেটাকে হিফ্‌যখানায় রূপান্তরিত করা হয়। এবং সেখানেই হিফ্‌য বিভাগের ছাত্রদের থাকা ও পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

মসজিদের অমন ব্যবহার আমি আমাদের গ্রামে দেখিনি। কিন্তু বড় হয়ে, হাদিস শাস্ত্রের বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম, ইসলামি ইতিহাসের সেই সোনালী দিনগুলিতে দিনরাত সর্বক্ষণ মসজিদের ফাটক খোলা থাকত। গরিব-দুঃখী-অনাথ-আশ্রয়হীনদের মাথা গুঁজবার ঠাই ছিল মসজিদ। মদিনায় নবি (সা)-এর মসজিদে একটি সুফ্‌ফা (চালা) লাগানো হয়েছিল। তার তলায় বসবাস করতেন আবু হুরায়রা (রা)-এর মতো দুঃখী অসহায় নিঃস্ব সাহাবি (নবির সহচর)-রা। তাই তাঁদেরকে ‘আস্‌হাবুস্‌ সুফ্‌ফা’ (চালার অধিবাসী) বলা হয়। সে-সময় মসজিদ চত্বরেই অনায়াসে চলত শিশুকিশোরদের ক্রীড়াকৌতুক। রাজনীতির মত গুরুগম্ভীর কাজকম্মের আসরও বসত মসজিদের ভেতর। বিদেশী দূতদের সাথে আলাপআলোচনাও হত। সমাজের বিচার, শালিসী সভা সব। পঠনপাঠন থেকে বিবাহ আরও কতকিছু যে সংঘটিত হত মসজিদের অন্দরে, ইতিহাসের পাতায় তা ধরা আছে। সময়ের সাথে সাথে সব কোথাও হারিয়ে গেছে। উবে গেছে সেসব রীতি-রেওয়াজ, উধাও হয়ে গেছে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আস্তে আস্তে এমন হয়ে গেছে যে, আজকাল দু’চারজনই দিনে-রাতে দু’চারবার মসজিদে যায়; অনেকে যায় সপ্তাহান্তে। কেউ কেউ তো তাও করে না। আর এভাবেই মসজিদ হারিয়ে ফেলেছে তার ব্যবহারিক গুরুত্ব, মানচিত্র জুড়ে প্রায় সব মুসলিম সমাজে!

সেখানে হিফ্‌যের বুনিয়াদী নিয়মকানুন দ্রুত শিখে নিয়ে তিন দিনের মাথায় কুরআন মুখস্থ করতে আরম্ভ করলাম। তখন আমার স্মৃতিশক্তি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল মনে হয়; ঐ ক’দিনে এক জুয্‌ (পারা) মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। মোট তেরো দিন ছিলাম। শেষের আগের দিন সকালবেলা নির্ধারিত অংশটুকু বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম যাতে ক্বারী (ঐ বিভাগে পারদর্শী ব্যক্তি) সাহেবকে শোনানোর সময় কোথাও আটকে না যাই, বা কোনো অংশ ভুলে না যাই। কিন্তু সেদিন এক অবাক কাণ্ড ঘটল, আমার আগের জন পড়া শোনাতে গিয়ে মাঝের কিছু অংশ ভুলে গেল। ক্বারী সাহেব রেগে গিয়ে তাকে মুরগা বানিয়ে দিয়ে আদেশ করলেন, ঐ অবস্থাতে ভুলে যাওয়া অংশটুকু বারবার ঝালিয়ে নিতে। এসব দেখে ভীষণ ভয় হল আমার। পেচ্ছাবের বাহানা করে ছুটে গেলাম বাথরুমে। কিছুক্ষণ পর যখন টিফিনের বেল বেজে উঠল, কোনোরকমে বইখাতা তুলে রেখে গেলাম প্রিন্সিপ্যালের অফিসে। পুরো ক্যাম্পাসে সবচেয়ে ছোট ছিলাম আমি। স্বভাবতই দু’ সপ্তাহে প্রায় সবাই চিনে গেছিল। অফিসে ঢুকেই হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। মুযাম্মিল স্যার কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আমার সব কথা শুনলেন। যেমনভাবে জাহাঙ্গীর ও তাঁর সহপাঠীরা শিখিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমন করেই গুছিয়ে বললাম সব কথা। শুনে তিনি আমায় ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে নিলেন।

1 comment:

  1. তুমি ভাগ্যবান.... আমার সুযোগ হয় নি... যদি ও আমি পরে অন্য ভাবে মাহাদ এর সাথে জুড়েছি... আর হেফ্জ খানা টাও তো এখন মেন টাউন এ...

    ReplyDelete