পিতৃস্নেহ
মুহাম্মদ হাবীব আল্-মা'লী, তিউনিসিয়া
(১)
সু’আদ অবাক হয়ে ভাবে, তার হৃদয়ের গভীরে যে
উথালপাতাল ঝড় বইছে সেটা তার বন্ধুবান্ধব বা তাকে যারা দেখতে আসছে, তারা কি আদৌ বোঝে না! বরং উল্টে তারা সর্বদাই
তার সুস্থতা, হাসিখুশি থাকার কামনা
করে। বাহ্যিক শান্তভাব কি মনের ভিতর দাউদাউ জ্বলতে থাকা আগুনকে লুকোতে পারে? তার দুই চোখে যে অব্যক্ত
বেদনা, চাপা কষ্ট—তা কি তারা দেখে না? তাদের উপস্থিতিতে তাকেও
সৌজন্যের হাসি হাসতেই হয়; কিন্তু সেটা যেন অন্যের হাসি হয়ে তারই কানে বাজে; করুণ আর্তনাদ হয়ে যেন
তারই কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। তবুও সে বাধ্য হয় ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি রাখতে- দেখলে মনে হবে দীর্ঘশ্বাস
নিতে বা প্রবল কান্নার কারণে তার অধরোষ্ঠ ঈষৎ ফাঁক হয়ে আছে।
যখনই সে একাকী আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, চেহারায় একটা কষ্ট আর শাস্তির ছাপ দেখে নিজেই চমকে ওঠে। অথচ মানুষ কেন যে বোঝে
না! আজ দীর্ঘ ছয়মাস হয়ে
গেল একটা কষ্ট, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা যেন তাকে গ্রাস
করেছে। এই দীর্ঘ সময়ে মন আর বিবেক, আবেগ আর কর্তব্যের মধ্যে চলতে থাকা অবিরত যুদ্ধের সামনে তার
হৃদয় আজ বিধ্বস্ত। সে আজ এমন এক সংকীর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে—যার একদিকে আছে তার স্বামী—যার প্রতি না আছে তার ভালোবাসা, না আছে সম্মান; অপর দিকে আছে তার প্রেমাস্পদ—যেন এক দেহ এক প্রাণ, শুধু কালের প্রবাহে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
(২)
মাহমুদ, সু’আদের স্বামী, বেশ সুদর্শন, সুপুরুষ। বৈবাহিক জীবনের শুরুর
দিকে একে অপরের প্রতি বেশ ভালোবাসা ছিল। কিন্তু বছর চারেক সংসার করার পর সু’আদের
সামনে স্বামীর দোষত্রুটিগুলো প্রকাশ পেতে থাকলো। তার ধারণা ছিল, স্বামী তার বড়
কোনো আইনজীবী। কিন্তু ক্রমশঃ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়—তার জ্ঞানও যেমন সীমিত,
সামর্থ্যও অল্প। তারপর এতদিন হয়ে গেল, এতটুকু নামযশও করতে পারেনি। তার যে কী
ভবিষ্যত, তা বর্তমান ও অতীতের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। আবার উত্তরাধিকারসূত্রে যা
সম্পত্তি পেয়েছিল তা-ও দেদার ওড়ায়—সেও আর বেশিদিন নেই। আরে, এটুকুই যদি হতো তবুও
মেনে নেওয়া যেত; কিন্তু তাদের উভয়ের মধ্যে কিছুই যে মেলে না—না স্বভাব, না অভ্যাস।
তদুপরি শেষ কয়েকটা মাস মাহমূদ মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যাবেলায় কোনো এক
মদের দোকানে বেরিয়ে যায়; ফেরে সেই ভোরের কিছু আগে। তখন এত টলমল করে যে দরজার তালায়
চাবিই লাগাতে পারে না। আর এতেই সু’আদের একেবারে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। স্বামীর প্রতি
ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধও তার অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এমন একটা বন্ধন তাদেরকে জুড়ে রেখেছে,
যা সে কোনোভাবেই ছিন্ন করতে পারছে না। কারণ ততদিনে তাদের কোলে জন্ম নিয়েছে এক
অনিন্দ্যসুন্দর শিশু ‘আমীন’—মায়ের কাছে যে ছিল অনুপম। সবে তিনে পা দিয়েছে; এর
মধ্যেই তার উচ্ছ্বলতা, বুদ্ধিমত্তা চোখে পড়ার মতো।
(৩)
এ তো গেল স্বামীর কথা। আর তার প্রেমিক আহমাদ! তাকে স্রষ্টা তৈরীই করেছে
মাহমূদের বিপরীত করে—সবকিছুতেই; তেমনই সু’আদের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্য
রেখে। প্রথমতঃ সে ছিল যেমন সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও সফল, তেমনই তিরিশে পা দেওয়ার
আগেই দক্ষ চিকিৎসক রূপে খ্যাতি কুড়িয়েছে অন্যদের ছাপিয়ে। তার সঙ্গে সু’আদের প্রথম পরিচয়, অসুস্থতার সময় চিকিৎসার
জন্য যখন তাকে ডেকে পাঠায় তখন থেকেই। সঙ্গত কারণেই একাধিকবার আসাযাওয়া করতে হচ্ছিল ডাক্তারকে।
আর সু’আদ প্রত্যেকবারই তার মধ্যে নতুনভাবে কোমলতা, লাজুকতা, উন্নত চিন্তাধারা
খুঁজে পেত। রোগটা তার কাছে আর অসুস্থতার কারণ নয়, বরং অভ্যাসে পরিণত হলো। ফলে যখনই
তার একা লাগত বা স্বামীর মাতলামিতে কষ্ট পেত সে চিকিৎসার অজুহাতে আহমাদকে ডেকে
পাঠাতো; মনের চিকিৎসা—যেটা তার হৃদয়কে আকাশের মুক্ত আঙিনায় নিয়ে যেত। তারা আলোচনা
করত সমকালীন ও প্রাচীন কবি-সাহিত্যিকদের কবিতা, নাটক নিয়ে যা ধীরে ধীরে তাদের মনের
অনুভূতি প্রকাশে গিয়ে শেষ হতো। তারা প্রতি মূহুর্তেই নিজেকে অন্যের চিন্তায়, মননে
আবিষ্কার করতো। বেশ চলছিল। কিন্তু ডাক্তার হঠাৎ একদিন বলে বসল, “সু’আদ... আমরা কেন
নিজেদেরকে এভাবে প্রতারিত করছি? আমরা তো একে অপরকে ভালোবাসি। এতে লুকোনোর কী আছে?”
ব্রীড়াবনতা নারী মাথা ঝুঁকিয়ে ইশারা করলো—কিন্তু তার চোখ থেকে দু-ফোটা অশ্রু গড়িয়ে
পড়লো আর এটাই বুঝি ছিল তার শ্রেষ্ঠ উত্তর। প্রায় প্রতিদিনই প্রণয়ীযুগলের সাক্ষাৎ
চলতে থাকলো আর তার স্বামী উদাসীন রইলো এই ক্রমবর্ধমান ভালোবাসার ব্যাপারে। মাহমূদকে
দেখলে বা তার ব্যাপারে কথা হলে আহমাদের কথায় যেন ঘৃণা ঝরে পড়তো আর সু’আদ না তার
সমর্থন করতো, না প্রতিবাদ। এদিকে ডাক্তারের প্রেমের অনল ক্রমে বাড়তে থাকে। তার আর
ধৈর্য থাকে না। সু’আদকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল সে তাকে নিয়ে পালাতে চায়—এমন এক
জায়গায়, যেখানে কেবল তারা একে অপরের জন্য বাঁচবে, পৃথিবীর কোনো কিছুই তাদেরকে বাধা
দিতে পারবে না। এই কথা শুনতেই সু’আদের হৃদয়ে মিশ্র অনুভূতি ভিড় করতে লাগলো—একদিকে
সন্তানস্নেহ ও স্বামীর প্রতি কর্তব্য; অন্যদিকে ডাক্তারের প্রতি গভীর অনুরাগ—যে
তার হৃদয়ের আসন অধিকার করে আছে, যার ছোঁয়ায় জীবনের সবকিছু সুখস্বাচ্ছন্দ্যে
পর্যবসিত হয়েছে। ডাক্তার তার কাছে যা চাইছে সেই বিরাট আত্মত্যাগের কথা যখন সে
বললো, ডাক্তার বললো সে-ও তার নামযশপ্রতিপত্তি ত্যাগ করে এসেছে শুধুই তাকে নিয়ে
যেতে।
অবশেষে ডাক্তার সু’আদকে পালানোর ব্যাপারে রাজি করতে সক্ষম হলো। ভোর চারটেয়
তারা পালাবে ঠিক করলো, যখন তার স্বামী কোনো পানশালায় বেহুঁশ পড়ে থাকে; কারণসুধার
পাত্র ছাড়া সেই সময় তার কাছে বিশ্বের সব কিছুই তুচ্ছ।
বিনিদ্র রাত কাটিয়ে মাহমূদ বাড়ি ফিরেই ত্বরিত পদে অভ্যাসমতো ডাইনিং টেবিলের
দিকে এগিয়ে গেল, সেখানে রাখা মদের বোতল থেকে আরও কয়েক ঢোঁক গেলার ইচ্ছায়। সেখানে
গিয়ে সে তার স্ত্রীর রেখে যাওয়া একটা চিঠি পেল। পড়লো বটে, কিন্তু বুঝতে পারলো না
ঠিক। বার দু’তিনেক পড়ার পর তার নেশা ছুটে গেলো, ঘোর কেটে গেলো। তৎক্ষণাৎ তার
হৃদয়কে আচ্ছন্ন করলো স্ত্রীকে হারানোর তীব্র কষ্ট—যে স্ত্রীকে সে তার হৃদয়ে দেবীর
আসনে বসিয়ে ছিল।
(৪)
এই বেদনাদায়ক ঘটনার পর তিনমাস কেটে গেছে। তার স্ত্রী এখন কোথায়
থাকে, মাহমূদ একদিন তা জানতে
পারলো। সে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো। কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার
ইচ্ছা তার ছিল না—সে স্ত্রী হোক বা তার প্রেমিক। বরং তার উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে এই ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট কাজটির
নীচতার উপলব্ধি দেওয়া।
একদিন সু’আদ অপ্রত্যাশিতভাবে, মাহমূদকে তার একেবারে ঘরের মাঝে দেখে চমকে উঠলো। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে
হয়ে গেলো। সে তার সামনে চোখ নামিয়ে, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর
নীরবতার পর মাহমূদই নীরবতা ভঙ্গ করলো। কম্পিত কণ্ঠে বললো—
—“আমার মনে হয়, তুমি ঘুণাক্ষরেও ভাবোনি সেই ব্যক্তিকে তোমার সম্মুখে দেখবে
যাকে তুমি লজ্জায়-অপমানে জর্জরিত করেছ। তুমি তো এর থেকেও আরও দূরে এমন কোথাও আত্মগোপন করতে পারতে
যেখানে আমি পৌঁছতে পারবো না। কিন্তু তুমি তা করোনি, আর তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
সু’আদের পা কাঁপতে লাগলো—এতই যে, মনে হলো মেঝের উপর পড়েই
যাবে। মাহমূদের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই, সে বলে চলেছে—
—“খুব ভয় লাগছে, তাই না? নাহ, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই আর তাছাড়া তোমার উপর অত্যাচার করার
বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। যদিও আমি তোমার স্বামী; তুমি যা করেছ তাতে তোমাকে মেরে ফেলা উচিত। কিন্তু আমি তো খুনী
নই। আর তোমাকে মেরে কীই বা ফিরে পাব? এটা কি আর প্রতিশোধ হলো? কখনোই নয়, এরকম প্রতিশোধের আমার দরকার নেই। আমি তোমাকে জীবিতই রাখতে
চাই, যাতে তুমি উপলব্ধি করতে
পারো যে আমি এখানে তোমার জন্যে আসিনি।”
—“আমাকে অভিশাপ দেওয়ার, তাচ্ছিল্য করার অধিকার তোমার আছে”—মুখ খুলল সু’আদ, “হ্যাঁ, আমি মানছি আমার পদস্খলন
হয়েছে। আমি তোমার প্রতি যেমন অন্যায় করেছি, তেমন নিজের উপরেও করেছি। আর এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত
করারও কোনো পথ নেই। যদিও আত্মপক্ষ সমর্থন করা সম্ভব, কিন্তু আমি তা কখনোই করবো না, কোনো অজুহাতও দেব না; কেননা আমার ভুল অমার্জনীয়। আমি অপরাধিনী, আর আমার পাপের গুরুত্ব
আমি জানি। কিন্তু আমি এও জানি যে তুমি কত মহান, কত দয়ালু। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো ধৃষ্টতাও আমার নেই। যে বড় পাপ করেছি, তোমার মতো সম্ভ্রান্ত
লোকের পক্ষে ক্ষমা করা সম্ভব নয়।”
—“তোমাকে তো বললাম ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি সম্পূর্ণ
নিরাপদ। যদিও আমার উচিত ছিল তোমার অপরাধের চুলচেরা হিসেব নেওয়ার, কিন্তু কী হবে
নিয়ে! বরং তোমাকে বিবেকের হাতেই ছেড়ে দেওয়া সমীচীন মনে হলো, যেন বিবেক তোমাকে
ইচ্ছেমতো দংশন করতে পারে।”
—“তাহলে তোমার এখানে আসার কারণটা কী?”
—“আমি আমার সন্তানকে চাই।”
—“তোমার সন্তান......!!”
—“হ্যাঁ, আমার! কোথায় সে?”
—“কিন্তু সে তো আমারও সন্তান!”
—“চুপ একদম! পাপিষ্ঠা নারী, প্রতারক স্ত্রীর অধিকার নেই
মাতৃত্বের দাবী করার।”
—“তাহলে কি তুমি আমার সন্তানকে ছিনিয়ে নিতে চাও আমার
থেকে?”
—“হ্যাঁ, আর সেজন্যই তো আমি এসেছি।”
সু’আদের চোখমুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সে চিৎকার করে উঠলো, “আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো
না।”
“এরকম দাবী তুমি করছ কী করে!”—মাহমূদ প্রত্যুত্তর দিল, “তোমার সঙ্গে থাকা
মানে তো ওকে তোমার লাঞ্ছনা, কালিমা বয়ে বেড়াতে হবে। দূর হও সামনে থেকে। সে আমার
সন্তান, তোমার নয়।”
—“কিন্তু আমি যে তাকে ভালবাসি।”
—“আমি কি তোমাকে ভালবাসিনি? বরং তোমার পূজা করেছি।”
বিস্রস্ত কেশ, ব্যাথাতুর হৃদয়—ভীত নারী বিস্ফারিতনেত্রে তাকিয়ে রইলো
স্বামীর দিকে। মাহমূদ বলতে থাকে, “আমি কখনোই চাই না, তোমার পাপের কলঙ্কে কলুষিত
হোক এই নিষ্পাপ, অসহায় বালকের কপাল। আমি শপথ করে বলছি যদি এই শিশু না থাকত আমি
কখনৈ এখানে আসতাম না। তোমাকে নিয়তির হাতেই ছেড়ে দিতাম। সময়ের সাথে সাথে তোমাকেও ভুলে যেতাম, যেভাবে তোমার ভালবাসাকে ভুলেছি। এমনকি আমার সন্তান না
থাকলে আমি হয়তো বাঁচতামও না এরকম কঠিন আঘাতের পর। আমি বেঁচে আছি কেবলমাত্র আমার
সন্তানের স্বার্থেই, তোমার থেকে প্রতিশোধ নিতে নয়। বুঝেছো? আমি তার জন্যই
বেঁচেছিলাম, বাঁচবও তারই জন্য। তুমি তোমার সব কর্তব্য পদদলিত করেছ। তোমার আমার
মাঝে কোনো সম্পর্কই আর বাকী নেই। এবার বল, আমার পুত্র কোথায়?”
—“না, আমি কখনোই বলবো না।”
—“তুমি বলবে কি?”
তার হৃদয় ভারাক্রান্ত, নাসিকা স্ফীত। ভীত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে
বললো,”আমি তাকে তোমার হাতে তুলে দেব না।”
—“তাহলে আমি নিজেই খুঁজে তাকে নিচ্ছি।”—ব’লে বন্ধ দরজার
দিকে এগিয়ে গেল মাহমূদ। ব্যাকুল সু’আদ তার ও দরজার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। মাহমূদ
তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকে বিদ্ধ করে বললো, “এবার বুঝলাম যে সে এখানেই আছে।”
সেদিকে পা বাড়াতেই সু’আদ চিৎকার করে উঠলো, “খবরদার, ঢুকবে না।”
—“সরে যাও বলছি।”
—“না।”
মাহমূদ তাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝের উপর ফেলে এগিয়ে গেল কিন্তু সে তৎক্ষণাৎ উঠে
পিছন থেকে তার কাপড় আঁকড়ে বলতে লাগল, “ঈশ্বরের শপথ, তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার আগে তুমি
আমাকে হত্যা করো।”
—“ছিনিয়ে কি তুমি নাওনি? সরো।”
—“না, এর থেকেও কঠিন প্রতিশোধ হয়? তোমার কি মনে
হয়,পাপিষ্ঠা নারীর হৃদয় বলে কিছু নেই যে তাকে তুমি পুত্রস্নেহ থেকে বঞ্চিত করবে?
হ্যাঁ মানছি আমি পাপিষ্ঠা, কারণ আমি তোমার বিশ্বাসভঙ্গ করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো,
এটা আমার অপরাধ নয়। তবুও আমি সমস্ত শাস্তি মাথা পেতে নেব। তুমি আমাকে মেরে ফেল,
আমি মরে শান্তি পাই।”
—“তোমাকে মারার আমার কোনোই ইচ্ছা নেই। আর তোমাকে জীবিত
ছেড়ে দেওয়াই আমার প্রতিশোধ। এখন থেকে তুমি সন্তানকে ছাড়াই থাকবে। এটাই আমার
প্রতিশোধ।”
সু’আদ তবু সরলো না। পা আঁকড়ে পড়ে থাকলো। মাহমূদ এবার রেগে গেলো।
তাকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো, “দূর হয়ে যাও সামনে থেকে।” ঘরের ভিতর
প্রবেশ করতেই তার চোখ পড়লো শিশুর দোলনার উপর। তার উপর ঝুঁকে আদর করতে সে জেগে
উঠলো। সামনে পিতাকে দেখে শিশুর মুখে হাসি নিয়ে আনন্দে “বাবা,বাবা” বলে হাততালি
দিয়ে উঠলো। সন্তানের মধুর কন্ঠে মাহমূদ আনন্দে বিহ্বল হয়ে গেল। শিশুকে বুকে জড়িয়ে
ধরে গভীর স্নেহে চুম্বন করতে লাগল, পাগলের মতো। আনন্দের আতিশয্যে বুঝতেই পারলো না
সু’আদ কখন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
—“বাছা আমার, শুধু তোর জন্যই বেঁচে আছিরে। আর সে কিনা
তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চায়! কখখনো নয়। সে যে আমার হৃদয় চুরমার করে দিয়ে সেটাই
বা কম কী?”
অবোধ শিশু কিছুই বোঝে না। ছোট্ট দুখানি হাত দিয়ে পিতার গলা জড়িয়ে ধরে
খিলখিলিয়ে ওঠে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের মুখের উপর। অবুঝ কন্ঠে সে বলে উঠলো, “মা…মা…এই দেখো বাবা এসেছে।”
মাহমূদের চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে মুখটা ঘুরিয়ে কিছু
বলতে যাবে, অভাগিনী নারী তার পায়ে
পড়লো, “আমাকে দয়া করো, ক্ষমা করে দাও।”
—“কখনোই না”—স্ত্রীর দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল মাহমূদ।
—“তোমার শপথ করে বলছি, ওই নিকৃষ্ট লোকটির প্ররোচনায় আমি এ
কাজ করেছি। কেন জানি না সে তোমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইত। আমাকে সামনে পেয়ে সে
সেই স্পৃহা মিটিয়েছে। তার পাতা ফাঁদে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন আমার সুমতি
হয়, বুঝলাম যে গর্তে পড়েছি সেখানে আমার জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করে আছে। আমি
নিজের কাছেই নিজে ছোটো হয়ে গিয়েছি। আমি তোমারই স্ত্রী, তোমাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা
করতাম। এখন তীব্র হতাশা আমাকে উন্মাদপ্রায় করে দিয়েছে। তোমার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা
ভাবলেই একটা লজ্জা ও অপরাধবোধ আমাকে গ্রাস করে। তুমি তো মহান, দয়ালু। আমি এটাও
জানি যে আমার পাপ ক্ষমার অযোগ্য। পুত্রের চিন্তায়, লাঞ্ছনার তীব্রতায়, বিবেকের
দংশনে আমি জর্জরিত। আমার দুষ্কর্ম দিয়ে তার নিষ্কলুষ দোলনাকে কালিমালিপ্ত করেছি।
তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, তোমার সম্ভ্রমকে ধুলোয় মিশিয়েছি। আমি অনুতপ্ত
হতে চেয়েছি, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে অনুতাপ করে আমি কী পাব? আমি তো কেবল তোমাকে
কলঙ্কিত করেছি। অপরাধী আমিই, তুমি তো মহৎ। আমার উচিৎ ছিল তোমার সামনে গিয়ে সত্য
স্বীকার করা। কিন্তু আমার ভয় হতো যে তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে না, ক্ষমাও করবে না;
মনে হতো তুমি আমাকে অপমান করবে। আর এটাই আমাকে আরও পীড়িত করত। তাই আমিই নীরবতাই
মেনে নিয়েছিলাম। আমার সন্তান যদি আমাকে এই মূহুর্তে না ডাকত, আমি তোমার কাছে কোনো
আবেদন করতাম না। আমি আজ দুর্দশাগ্রস্ত, ধ্বংসের মুখে। তোমার কাছে আমার বিনীত
অনুরোধ আমার সন্তানকে আমার কাছে রেখে যাও। আমি কথা দিচ্ছি কয়েকদিন পরেই তোমাকে দিয়ে
দেব। এই ক’দিনে মানসিক শাস্তি ও বিবেকের দংশনকে সহ্য করে নিতে চাই।”
মাহমূদের গাল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে বিড়বিড় করে বললো,
—“যথেষ্ট হয়েছে, থামো এবার। ধর তোমার ছেলেকে। আর যদি চাও
তো আমার সঙ্গে আসতে পারো।”
মাহমূদ দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
অনুবাদ- কাজী মহাঃ মাকিন
No comments:
Post a Comment