পবিত্রতা-অর্জনঃ উপকরণ ও পদ্ধতি
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
‘আত্-ত্বাহুরু শাত্রুল্ ঈমান’ (পবিত্রতা অর্ধেক ঈমান) রাসুল (সা)-এর একটি হাদিস। এই হাদিসটি প্রায়শই এর-ওর মুখে, জালসা-জুলুসে উচ্চারিত হতে শুনি। কিন্তু যখন মুসলিম এলাকাগুলোর ছবি চোখে ভেসে উঠে, দেখি কথা ও কাজের মাঝে ব্যবধানের এক মহাসমুদ্র। অথচ ইসলাম বেশ জোরালো ভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্জনের আদেশ দিয়েছে। বহু ইবাদত-উপাসনার ক্ষেত্রে পবিত্রতা পূর্বশর্ত, ব্যক্তি-স্থান-পাত্র সব দিক থেকেই। বিশেষ করে সালাত; “পবিত্রতা ছাড়া সালাত কবুল হয় না” [মুসলিম ২২৪]। প্রয়োজনে পুনরায় পবিত্রতা অর্জন করতে হবে [বুখারি ১৩৫, মুস্লিম ২২৫] এবং পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কারণ পবিত্রতা অর্জনকারীদের আল্লাহ্ ভালোবাসেন [সূরা আল্-বাক্বারাহ ২২২] আর পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে যারা অবহেলা করে কবরে তাদেরকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে [বুখারি ২১৩, মুসলিম ৪৪৪]।
ত্বাহুর ও ত্বাহারাত শব্দের অর্থ পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা [আল-মু‘জামুল ওয়াসীত, পৃ ৩৮৭]। ইসলামে বাহ্যিক পবিত্রতার পাশাপাশি অন্তরকে অংশিবাদ থেকে পবিত্র রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও গোপন শত্রুতা থেকে নিজেকে বিরত রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ [সূরা আত্-তাওবাহ্ ২৮]। পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বহু বিধান পালনে পবিত্রতা পূর্বশর্ত। পবিত্রতা ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। তাই কুরআন ও হাদিসে পবিত্রতা অর্জনের যথেষ্ট তাগিদ এসেছে। সিহাহ সিত্তাহ্ (হাদিস শাস্ত্রের বিখ্যাত ছ’টি গ্রন্থ, অনেকে একে কুতুব সিত্তাহ্ বলে)-সহ অন্যান্য প্রায় সব হাদিসগ্রন্থেই ‘কিতাবুত্ ত্বাহারাত’ (পবিত্রতা সম্পর্কিত অধ্যায়টি) শুরুতেই সন্নিবেশিত হয়েছে। কারণ ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু তাই নয়, পবিত্রতা অর্জন করা-কে আল্লাহর ভালোবাসা লাভের উপায় বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অনুশোচনাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ [সূরা আল্-বাক্বারাহ্ ২২২]।
ইসলামে স্থানের পাশাপাশি শরীরের পবিত্র হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই শরীর অপবিত্র হলেই পবিত্রতা অর্জন করা জরুরী হয়ে পড়ে। মলমূত্র, রক্ত, বমি, বীর্য, পেশাব-পায়খানা ও উভয় দ্বার থেকে নির্গত অন্যান্য বস্তু, মদ, হারাম পশুর পেশাব-পায়খানা ও দুধ, শূকরের মাংস-পশম-হাড় সবকিছু, হালাল পশুপাখির পায়খানা ও পুঁজ, মৃত পশুর মাংস-চর্বি ইত্যাদি শরীর বা কাপড়ে লাগলে তা ধৌত করা ও পবিত্রতা অর্জন করা জরুরী হয়ে পড়ে। পেশাব-পায়খানা ও বায়ু নিঃসরণ হ’লে ওযূর মাধ্যমেই পবিত্রতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু স্ত্রী-মিলন ও তদ্রূপ ক্ষেত্রে পবিত্রতা অর্জনের জন্য ফরয গোসল করা আবশ্যিক। পেশাব, পায়খানা ইত্যাদি শরীরে বা কাপড়ে লেগে গেলে পানি দ্বারা ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন হয়। তবে জল না পেলে তায়াম্মুম (বিশেষ পদ্ধতিতে মাটি-স্পর্শ) যথেষ্ট [সূরা আন্-নিসা ৪৩, সূরা আল্-মায়েদাহ্ ৬]। এবং বিধি মেনে পবিত্রতা অর্জন করা অত্যাবশ্যক [সূরা আল্-মুদ্দাস্সির ৪, আল্-বাক্বারাহ ১২৫, সহিহ মুসলিম ২২৫, ২২৬]।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গোসলখানায় পেচ্ছাব করা অশোভনীয় এবং ঘৃণ্য
(তবে পেচ্ছাবের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকলে তাতে দোষের কিছু নেই)। একইভাবে পেচ্ছাব-পায়খানার সময় তাড়াহুড়ো করাও অনুচিত। কেউ কেউ প্রস্রাব শেষে তাড়াহুড়ো করে উঠে যায়, ফলে ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব পড়ে তার শরীর ও কাপড় অপবিত্র হয়ে যায়। এ জন্য ধীরে-সুস্থে প্রস্রাব করে পরিপূর্ণ ভাবে পরিষ্কার করাই বাঞ্ছনীয়। জল মজুত না থাকলে শুধু ঢিলা-কুলুখ্ দিয়েও পবিত্রতা অর্জন করা যায়। তবে গোবর, হাড়, কয়লা ইত্যাদি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যাবে না (তির্মিযি ১৬, মুস্লিম ২৬২)। রোগব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য এবং পূর্ণভাবে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে জলের কোনো বিকল্প নেই। এটি রাসূল (সা)-এর একটি সুন্নত। তিনি কোনো-এক মর্মে বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম অযু করে। অতঃপর নিজের মুখ ধোয় তখন অযুর পানির শেষ ফোঁটার সাথে তাঁর চেহারা থেকে সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ যায়, যে-পাপ সে তাঁর দু’চোখ দিয়ে করেছিল। যখন সে তাঁর দু’হাত ধোয় তখন অযুর পানির শেষ ফোঁটার সাথে তাঁর উভয় হাত থেকে সব গুনাহ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়, যেসব গুনাহের কাজে তাঁর হাত শরিক হয়েছিল...। আর এভাবেই সে তাঁর সকল গুনাহ থেকে নিস্তার পেয়ে যায়।’ [মুস্লিম ২৪৪, ২৪৫]। তাছাড়া, পবিত্রতা মানুষকে শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে এবং কবরের আযাব থেকে রক্ষা করে। এতে দেহ ও মন সজীব এবং সতেজ হয়। হৃদয়ে প্রফুলতা আসে। ইবাদতের স্বাদ অনুভূত হয়।
পবিত্রতা অর্জনের প্রধান মাধ্যম হল জল। যে জলের রং, স্বাদ, গন্ধ কিছুই পরিবর্তন হয়নি; যেমন- বৃষ্টি, নদী, সাগর, বরফ, কূপ, ঝর্ণা ইত্যাদির জল দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা সিদ্ধ [সূরা আল্-আনফাল ১১, সূরা আল্-ফুরক্বান ৪৮, আবু দাউদ ৮৩, তিরমিযি ৬৯, নাসায়ি ৫৯, ইবনু মাজাহ ৩২৪৬]। তবে জলে বৈধ কোনকিছু মেশালে সে জল নিজে পবিত্র কিন্তু অন্যকে পবিত্র করতে পারে না। আর জল কম হোক কিংবা বেশী, তাতে অপবিত্র বস্ত্তর মিশ্রণের ফলে বা নোংরা কিছু পড়ে যাওয়ায় যদি জলের রং, স্বাদ, গন্ধ কোনো একটির পরিবর্তন হয় তাহ’লে সে-জল
শরিয়তের দৃষ্টিতে অপবিত্র বিবেচিত হবে। আর এমন জলের ব্যবহার অবৈধ। পক্ষান্তরে যদি রং, স্বাদ ও গন্ধ এই তিনটি গুণের সবগুলিই ঠিক থাকে তাহ’লে তা পবিত্র বলে গণ্য হবে এবং তার দ্বারা পবিত্রতা অর্জন শরিয়ত সম্মত। এবং, জলে যদি কোনো পবিত্র বস্ত্ত মিশে যায় যেমন- গাছের পাতা, সাবান, কুল ইত্যাদি এবং রং, স্বাদ, গন্ধ এই তিনটি গুণের সবগুলোই ঠিক থাকে তাহ’লে সেই জল পবিত্র বলে গণ্য হবে এবং তার দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। কিন্তু যদি উল্লেখিত তিনটি গুণের কোনো একটি নষ্ট হয়ে যায় তাহ’লেও সে জল পবিত্র; অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে সে-জলের ব্যবহারও বৈধ। তবে তার দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গরম জল দিয়ে অযু ও গোসল বৈধ। এমনকি ব্যবহৃত জল দ্বারাও পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। তবে শর্ত হ’ল রং, স্বাদ ও গন্ধ ঠিক থাকতে হবে [বুখারি, ১৮৮, ১৮৯]। এবং স্ত্রীর সাথে একই পাত্রে অযু করাও বৈধ [বুখারি ১৯৩]। এছাড়া মানুষ ও গৃহপালিত পশুর উচ্ছিষ্ট জলও পবিত্র [মুসলিম, ৩০০, আবু দাউদ, ৭৫, তিরমিযি, ৯২]। যদিও যে-সকল পশুর মাংস হারাম তাদের উচ্ছিষ্টের পবিত্রতা-অপবিত্রতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ মতে, কুকুর এবং শুকুর ব্যতীত অন্য সকল পশুর উচ্ছিষ্ট পবিত্র [বুখারি, ১৭২, মুসলিম, ২৭৯, সূরা আল্-আন‘আম ১৪৫]। তবে পানির পরিমাণ যদি দুই কুল্লাহ্ (আনুমানিক ১৬০ লিটার)-এর কম হয় এবং ঐ সকল পশুর খাওয়া ও পান করার ফলে রং, স্বাদ ও গন্ধের
কোন একটা বদলে যায় বা বিগড়ে যায় তাহ’লে তা অপবিত্র গণ্য হবে [আবু দাউদ, ৬৩]।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কমোড বাথরুমগুলোতে অপবিত্র হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ। তাই সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরী। তাছাড়া, পথেঘাটে অনেক সময় কিছু পেশাবখানায় দাঁড়িয়ে পেশাব করতে বাধ্য হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, যেখানে বসে পেচ্ছাব করলে ময়লা লাগার কিংবা পেচ্ছাবের ছিটে গায়ে বা কাপড়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে এমন স্থান ছাড়া অন্যত্রে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করা অবৈধ।
যেহেতু, অযু এবং পবিত্রতা অর্জন সালাতের মতো বহু ইবাদতের পূর্বশর্ত [সুরা আল্-মায়েদা ৬], “অপবিত্র হয়ে গেলে পবিত্র না-হওয়া পর্যন্ত কোনো নামাযই কবুল হয় না” [বুখারি ১৩৫] এবং “উত্তমরূপে পবিত্রতা সম্পাদনকারীদের আল্লাহ ভালবাসেন” [সূরা আত্-তাওবাহ্, ১০৭], সেহেতু, সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র থাকা আমাদের সকলের জন্য
মঙ্গলময় ও বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে আমরা যখন নামাযে দাঁড়াবো অবশ্যই খেয়াল রাখবো যে, আমাদের পোশাক পবিত্র কিনা। আমাদের দেহ পবিত্র কিনা। অপবিত্র অবস্থায় কোনোভাবেই নামাযে দাঁড়ানো যাবে না। কি ঠাণ্ডা, কি গরম, কোনো অবস্থাতেই পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত চলবে না। তবে, যারা অসুস্থ, পানি স্পর্শ করলে ক্ষতি হতে পারে বা যারা সফরে রয়েছে পানি পাচ্ছে না কেবল তাঁদের জন্য ইসলাম তায়াম্মুম (বিশেষ ভাবে মাটি স্পর্শ করে পবিত্রতা অর্জন করা)-এর সুবিধা বিধিবদ্ধ করেছে। যাতে করে দ্বীন-পালন ও ধর্মীয় অনুশাসন মানুষের জন্য সর্বদা সহজ ও
মঙ্গলময় হয়!
[পূবের কলম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, দীনদুনিয়া-য় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment