Thursday 28 February 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ কিশানগঞ্জের পথে

Image may contain: one or more people, people standing, outdoor and text
 মাদ্‌রাসার সেই দিনগুলি...! 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম


কিশানগঞ্জের পথে
নব্বইয়ের দশক সমাপ্তির দোরগোড়ায়; তখন আমি কদমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের পাশাপাশি রোজ সকালে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে গিয়ে হাজির হতাম গ্রামের মকতবে। সেখানে আমাদের পড়ানো হতো আরবি। সেই সাথে শেখানো হতো সামাজিক রীতিনীতি, শিষ্টাচার, ইসলামী আদব-কায়দা, নামায-কালাম ইত্যাদি। কিছুদিনের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা দিল, ডানপিটে, দুরন্ত, গেছো ছেলেটি কেমন শান্ত স্বভাবের হয়ে গেল! এই দেখে অসিমুদ্দিন ও মহুবা খাতুন বুকে পাথর বেঁধে তাঁদের ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন বাড়ি থেকে বহু দূরে কিশানগঞ্জে, জামিয়াতুল ইমাম আল-বুখারি’তে।   

ইমাম বুখারি (১৯৪ – ২৫৬ হি)। মুসলিম সমাজে একটি সুপরিচিত নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা এবং অপরাজেয় হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক। আক্ষরিক অর্থেই একটি বিপ্লব একটি আদর্শ। অনুপ্রেরণার একটি মাইল ফলক। হাদিস শাস্ত্রের এক বিজয়ী সম্রাট। তাঁর সংকলিত মহামূল্যবান হাদিসগ্রন্থ ‘সাহীহুল্‌ বুখারী’ বিশুদ্ধতার নিরিখে দ্বিতীয়; আল্‌-কুরআনের পরেই যার স্থান। তাঁরই কর্ম-পদ্ধতিকে আদর্শ ক’রে গড়ে উঠেছে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলা ও বিহারের মিলন-স্থানে। কিশানগঞ্জের খাগড়ায় একটি পিছিয়ে পড়া মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় জ্বলে উঠেছে জ্ঞানের এক প্রদীপ, আলোর এক মশাল ‘জামেয়াতুল্‌ ইমাম আল্‌-বুখারি’ নামে  

১৯৮৮ সালের মাঝামাঝিতে বাঁশের বেড়া ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি চার কামরার একটি আঙ্গিনায় অঙ্কুরিত হয়েছিল একটি কিশলয়। চারা গাছটি রোপণ করেছিলেন আব্দুল মাতিন; আমি না, তিনি আব্দুল মাতিন সালাফি। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে নিজ সমাজকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার ব্রত নিয়ে শুরু করেন এই যাত্রা। রোপিত ঐ চারাটিকে দিবারাত্রি জল সিঞ্চন করে একটি প্রকাণ্ড মহীরুহে রূপায়িত করেন তিনি ও তাঁর সহকর্মী-সহযাত্রী মুযাম্মিল-ইউসুফ-মুনিরুদ্দিনরা। তাঁর তিরোধানের পর, বর্তমানে সেই মহীরুহের শীতল ছায়া ও সুমিষ্ট ফল মানচিত্রের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে সদা তৎপর তাঁর উত্তরসূরি মতিউর রহমান মাদানি ও তাঁর সহযাত্রীরা।

ক্লাস থ্রি পাশ করে সবে ফোরে উঠেছি। রমযানের ছুটিতে জাহাঙ্গীর বাড়ি ফিরেছে। জাহাঙ্গীর ঐ মাদ্‌রাসায় আমাদের গ্রামের প্রথম ছাত্র। বর্তমানে ও সৌদি আরবে জনকল্যাণ ও সচেতনতামূলক কোন এক সংস্থায় অনুবাদকের কাজ করে। আসার পথে বাবার কথা মতো সাথে নিয়ে এসেছে এডমিশন ফর্ম। এক রাতে ইসমাইল দা আমাদের বাড়ি আসল। আমাদের গ্রামে তখন সে-ই একমাত্র ইংলিশে এম এ। বাবার অনুরোধে ইসমাইল দা বাড়ি এসে ফর্ম ফিল-আপ করে দিয়ে গেলপরের দিন সকালে মেজদা গিয়ে পোস্ট করে দিল সেই চিঠি।

সেবার রমযানে প্রায় সতেরটা রোযা রেখেছিলামইসলামে ছোট থেকেই আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, রীতিনীতি শেখানোর বিধান রয়েছে। যাতে বড় হয়ে সেসব অনুশাসন মেনে চলতে অসুবিধা না হয়। আমাদের গ্রামের জাহের কাকু ছোট বেলায় রোযা রাখেননি। হয়তো তাই বড় হয়ে, এমনকি বুড়ো বয়সেও তিনি রোযা রাখতে পারতেন না। তাঁর প্রসঙ্গ টেনে বাবা আমাকে রোযা রাখতে উৎসাহ দিতেন, যখন আমার বয়স আট তখন থেকেই। সেবার ঈদে নতুন জামাকাপড় তেমন কেউই নেয়নি। বাবা, মা, দুই দাদা কেউ না। সেই টাকা দিয়ে আমার জন্য নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা, লুঙ্গি-গেঞ্জি, জামাকাপড় ও হস্টেলের অন্যান্য জরুরি আসবাবপত্র কেনা হয়েছিল।

ঈদের সাত দিন পর, মেজদা সাইকেলে করে আমাকে কুশমুণ্ডি পৌঁছে দিলসাথে জাহাঙ্গীর ও রফিকওশুক্রবারের দিন ছিল। কুশমুণ্ডির মসজিদে জুম্‌আর নামায পড়ে দেড়টা নাগাদ বালুরঘাট-ইসলামপুর স্টেট বাসে চেপে রওয়ানা হলাম। এই প্রথম এত দূরে। সাথে বাড়ির কেউ না। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। মনের মাঝে পুলক ও উদ্বেগের মিশ্রণ শরীরের লোমকূপগুলোকে শিহরিত করে তুলছিল মুহুর্মুহু। মাঝে মাঝেই ভিজে যাচ্ছিল দু’ চোখের পাতা। সেদিনই সে-বাসে কিশানগঞ্জ যাচ্ছিল আমাদের এলাকার আরও কিছুজন। তাঁদের অনেকেই আমাকে স্নেহ করে ভালোবাসা ও অভয় দিল। সৌদ দা, সে এখন রায়গঞ্জের কোনো এক হাই মাদ্‌রাসায় শিক্ষকতা করে, আমার সাথে শিশুসুলভ মশকরা করছিল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, দাদা আপনি কোন ক্লাসে পড়েন। মজা করে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি’। এরকম আরও অনেক মজার আলাপচারিতা করেছিল সে।

তিন সাড়ে-তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে নামলাম খাগড়ায়। খাগড়া নামটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেই ছোটবেলায়। মা’র কাছে গল্প শুনেছিলাম, আমার নানা বন্ধুবান্ধবের সাথে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে খাগড়ার মেলায় যেতেন। পনেরো দিন-এক মাস থেকে গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরতেন। ফেরার সময় আমার মা-মাসিদের জন্য হালওয়া ও শনপাপড়ি কিনতে কখনোই ভুলতেন না। আর আমার দুই মামার জন্য আনতেন খেলনা গাড়ি। মাঝে বাবা ও বড় আব্বুর কাছেও খাগড়া মেলার বহু গল্প শুনেছি। সে-সব শুনে মনের ক্যানভাসে খাগড়ার যে ছবি এঁকেছিলাম, নেমে দেখলাম, দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক!


1 comment:

  1. স্যার খুব ভাল লাগল৷ পরের কিস্তিটা কবে আপলোড হচ্ছে৷

    ReplyDelete