উত্তরাধিকারে সমতাঃ নারী-প্রসঙ্গ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম*
ভূমিকা
নারী হোক বা পুরুষ, প্রত্যেকের জীবনে অর্থনৈতিক অধিকার যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তা
কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। উত্তরাধিকার সূত্রে নারী ও পুরুষের প্রাপ্যাংশ
ইসলামে নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আজ যখন নারী সংক্রান্ত প্রায় সব বিষয়ে আলোচনা সর্বত্র তুমুল ভাবে চলছে; তখন সেসব বিষয়ে ইসলামী বিধান, দৃষ্টিকোণ
ও নীতিমালা কী বা কেমন সে-আলোচনাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে[1]। বিশেষ করে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার ও উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে। আর এ প্রসঙ্গে ইসলামী নীতিমালার সমালোচনায়
এবং উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতার দাবীতে কি প্রাচ্য কি প্রতীচ্য
আজ সকলেই সরব ও মুখর।
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা
নিঃসন্দেহে সমাজের সবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমানে
অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা দ্বারা এক জন ব্যক্তি সমাজে নিজ মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম
হয়। তাই
পৃথিবীর বহু সমাজে, বহু সংস্কৃতিতে প্রায় সকল অর্থনৈতিক অধিকার দীর্ঘদিন কেবল পুরুষদের
জন্য কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিল। আইন প্রণয়ন করে নারীদেরকে অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল
এমনকি বঞ্চিতও করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা প্রায় দাস-তুল্য ছিল। সেই দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে শুরু হল এক রেনেসাঁ-আন্দোলন, নারীর মর্যাদা ও অধিকারকে ঘিরে। অবস্থার অবসান চেয়ে নারীকে উপার্জনশীল করে
তুলতে প্রাচীন খোলস ত্যাগ করল ইউরোপ[2]।
নারীরা মুক্তির স্বাদ পেল। লাভ করল অর্থনৈতিক অধিকার। কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকারও পেল তারা। কিন্তু সবার অজান্তেই অমঙ্গলের
এক নিকষ কালো মেঘে ঢেকে গেল দাম্পত্য, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। হয়তো তাই, চির-শাশ্বত
আদর্শ ইসলাম এই দু’য়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করে নারীকে
দিয়েছে অর্থনৈতিক অধিকার, উত্তরাধিকারের মাধ্যমে
তার প্রাপ্যাংশ ধার্য করে। সেই সম্পদের উপর
তার পূর্ণ মালিকানা ও স্বত্ব কায়েম করেছে। এমনকি সেই অর্থ ব্যয় করার অধিকার তার পিতা, স্বামী বা অন্য কারুর নেই। উপরন্তু কোন ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করলে অথবা নিজ শ্রম দ্বারা অর্থ উপার্জন করলে সে-সবের
মালিকানা তারই থাকবে। তা সত্ত্বেও তার ভরণ-পোষণের
সব দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে স্বামীর। স্ত্রী যতই ধনবান হোক না কেন, তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীকেই
নিতে হবে। এভাবেই ইসলামে নারীর আর্থিক অবস্থাকে এত সুদৃঢ় করে দেওয়া হয়েছে যে, অনেক সময় নারী পুরুষ অপেক্ষা অধিক
অর্থবান ও সম্পদশালী হয়[3]।
উত্তরাধিকার-নীতি ও নারী
উত্তরাধিকার সম্পর্কিত নীতিমালা
ও আলোচনা ইসলামী শরিয়ত ও ফিক্হের একটা বড় অধ্যায়। পরিভাষায় সেই অধ্যায় ও
শাস্ত্রকে ইল্মুল্ ফারায়িয বলে। পবিত্র কুরআনে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত
বহু আয়াত রয়েছে। বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে উত্তরাধিকার
সংক্রান্ত সবার অধিকার ও প্রাপ্যাংশ নিয়ে[4]। সেসবের আরও বিশ্লেষিত রূপ মজুত আছে হাদিসের বিভিন্ন
সংকলনে[5]। তবে বর্তমানে সমতার দাবীতে যে বিতর্ক চলছে তার
সূত্রপাত হয়েছে কুরআনের একটি আয়াতের
অংশকে কেন্দ্র করে। সেটি হল, “পুরুষ দুই নারীর অংশের সমান পাবে”[6]। যদিও এই আয়াতে নারীর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত
কেবল একটি নীতির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে, তথাপি প্রাচ্যবিদ ও মুক্তমনা লেখকেরা এই আয়াতকে কেন্দ্র করে ইসলামে নারীর মর্যাদার ব্যাপারে
নানা সংশয় সৃষ্টি করেছে এবং উত্তরাধিকারে পুরুষ ও নারীর এই পার্থক্যকে কেন্দ্র করে ইসলামকে
বিভিন্ন ভাবে আক্রমণ করে
চলেছে।
এই আয়াতাংশে নারীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে তা সর্বক্ষেত্রের জন্য নয়। সর্বক্ষেত্রে সমস্ত নর ও নারীর জন্য এই নীতিই সাব্যস্ত হবে, এমনটা নয়। এই আয়াতে বা অন্য কোথাও একথা বলা হয়নি যে, উত্তরাধিকার সম্পর্কে
মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যেকোনো দু’জন নারীর সমপরিমাণ অংশ একজন পুরুষ পাবে। এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে
এই নির্দেশ দিচ্ছেন যে দু’জন কন্যার সমপরিমাণ অংশ একজন পুত্র পাবে। অর্থাৎ প্রাপ্যাংশের এই পার্থক্য উত্তরাধিকারের সমস্ত ক্ষেত্রের জন্য নয়। বরং এই বিধান একটি
নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য।
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ইসলামী
নীতিমালার এবং সে-বিষয়ে আয়াত ও হাদিসগুলির সঠিকভাবে পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উত্তরাধিকারী নারী ও
পুরুষের প্রাপ্যাংশে এই পার্থক্যের মানদণ্ড
উত্তরাধিকারীর পুরুষ বা নারী হওয়া নয়। বরং উত্তরাধিকারের এই দর্শনের মধ্যে আল্লাহ্ তাআলার
এক মহাপ্রজ্ঞা কাজ করছে। আর তা হল, উত্তরাধিকারের এই
পার্থক্য উত্তরাধিকারীর লিঙ্গ-পরিচয়ের কারণে নয়। বরং এই পার্থক্য দায়িত্বের
নিরিখে। উত্তরাধিকারে নারী ও পুরুষের প্রাপ্যাংশে এই যে পার্থক্য তার যৌক্তিকতা আরও স্পষ্ট হয় নিম্নের এই তিনটি
দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনা করলে।
(ক) লিঙ্গ-সমতাঃ লিঙ্গ-সমতা (Gender Equality)-কে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ে
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজের ভেতরে এক তুমুল ঝড় উঠেছে। সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান বলে নিরন্তর প্রচারণা চলছে। আর এসব চলছে নারী-পুরুষ উভয়ই সমপর্যায়ের, এমনকি তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী-
এই ধারণাকে কেন্দ্র করে। তবে এ বিষয়ে ইসলামের ভাষ্য হল, নারী ও পুরুষ
উভয়ই একই আত্মা হতে সৃষ্ট।
তবে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং
একে অপরের পরিপূরক[7]। কুরআন ও হাদিসে যত
প্রকার আদেশ ও নিষেধ এসেছে তা নারী ও পুরুষ
উভয়ের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। নামায, রোযা, হজ, যাকাত এবং সামাজিক সর্ব প্রকার রীতিনীতিতে একই
ধরণের আদেশ-নিষেধ ও বিধিবিধানের আওতাভুক্ত করা হয়েছে
নারী-পুরুষ উভয়কে। তবে উত্তরাধিকার-প্রপ্তির ক্ষেত্রটা
একটু ভিন্ন রকম। উত্তরাধিকারের কিছু
ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের তুলনায় বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে
তো কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের জন্য নারীর তুলনায় অধিক প্রাপ্যাংশ ধার্য করা হয়েছে। তবে উত্তরাধিকার ও অন্যান্য সকল সামাজিক ক্ষেত্রে সমতার সাথে ‘আদল’-কে ইসলাম মানদণ্ড করেছে[8]। ‘আদল’ হল, যাকে যে পরিমাণ দায়িত্ব দেওয়া হয় ঠিক সেই অনুপাতে তাকে অধিকার প্রদান করা[9]। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকেই পুত্রের আর্থিক দায়ভার তার নিজের উপর বর্তায়। বিবাহের পর স্ত্রী এবং সন্তানদের দায়ভারও তার উপর বর্তায়[10]। অনেক ক্ষেত্রে অসহায় পিতামাতা ও ছোট ছোট ভাইবোনদের দায়ভারও তাকেই নিতে হয়। অপরদিকে কন্যাকে নাতো নিজের দায়ভার নিতে হয় আর না পিতামাতার। এমনকি খোদ
কন্যার দায়ভার বিয়ের আগে পিতা ও বিয়ের পরে স্বামীকে নিতে হয়। আর এ
কারণেই উত্তরাধিকার বণ্টনের কেবল এ ক্ষেত্রেই
নারীকে পুরুষের অর্ধেক অর্থাৎ কন্যাকে পুত্রের অর্ধেক প্রদান করা হয়[11]।
(খ) উত্তরাধিকারীদের নৈকট্য ও দায়িত্বঃ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কে মৃতের অধিক নিকটবর্তী-
উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ণায়ক। যে
ব্যক্তি মৃতের যত বেশি
নিকটবর্তী হবে উত্তরাধিকারে সে তত বেশি
অংশের অধিকারী হবে। যে যত দূরের হবে উত্তরাধিকারে
সে ততই কম অংশ পাবে। এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের লিঙ্গ বিবেচনাযোগ্য নয়। তাছাড়া যে উত্তরাধিকারীরা জীবনের প্রায়
সব স্তরে থাকে এবং তাদের উপর অধিক দায়িত্বভার অর্পিত হয় তারা অপেক্ষাকৃত বেশি অংশ পাবে ওই সব উত্তরাধিকারীদের তুলনায় যারা জীবনের কোন
কোন স্তরে থাকে এবং
তাদের উপর দায়িত্বভারও কম বর্তায়। বরং তাদের দায়দায়িত্ব অন্যের কাঁধে চাপে।
(গ) উত্তরাধিকারীদের লিঙ্গ
পরিচিতি গুরুত্বহীনঃ উত্তরাধিকারীদের পুরুষ বা নারী হওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, মৃতের মেয়ে তার মা অপেক্ষা বেশি অংশ পায়, অথচ উভয়ই নারী। মৃতের
মেয়ে মৃতের পিতা অপেক্ষা বেশি
অংশ পায়, যদিও সে দুগ্ধশিশু কন্যা হয় এবং মৃত পিতার আকৃতি পর্যন্ত তার মনে না থাকে। তাই মৃত
ব্যক্তি যদি পিতা ও কন্যাকে ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তাহলে কন্যা একা অর্ধেক সম্পদের মালিক হবে। অনুরূপভাবে মৃত
ব্যক্তি যদি পিতা ও পুত্র রেখে মারা যায় তাহলে পুত্র পিতার থেকে বেশি অংশ পাবে, অথচ দু’জনই পুরুষ। তাই, উত্তরাধিকারীদের লিঙ্গ পরিচিতি কখনোই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নারীপুরুষের প্রাপ্যাংশের পার্থক্য
ইসলামের উত্তরাধিকার আইনের মৌলিক মানদণ্ড
অত্যন্ত প্রজ্ঞাময় ও সুসংগত। সে বিষয়ে মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ ও
গভীর অধ্যয়ন খুব জরুরী। উত্তরাধিকারীর পুরুষ বা নারী হওয়ার সাথে
এই মানদণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। অতএব উত্তরাধিকারীদের নৈকট্য ও তাদের স্তর
যদি এক ও অভিন্ন হয়, যেমন মৃতের পুত্র ও কন্যা, তাহলে আর্থিক দায়িত্বভারই তাদের উত্তরাধিকারের অংশে পার্থক্যের কারণ হয়ে
দাঁড়ায়। এ জন্যই কুরআন সকল উত্তরাধিকারীর মধ্যে এই পার্থক্যের
বিধান দেয়নি। বরং একে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। কুরআন ঘোষণা করেছে, “আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দু’মেয়ের অংশের সমপরিমাণ[12]। এই ক্ষেত্রে পার্থক্যের কারণ
হল, পুরুষের উপর, অর্থাৎ মৃতের পুত্রের উপর তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির লালন-পালনের দায়িত্বভার অর্পিত হয়। অপরপক্ষে মৃতের কন্যা এবং তার সন্তান-সন্ততির সমস্ত দায়িত্বভার অর্পিত হয় তার স্বামীর উপর। তাই যদিও ভাই বোনের দ্বিগুণ এবং বোন ভাইয়ের অর্ধেক পাচ্ছে, তবুও যদি সত্যিকারে দেখা যায় তাহলে কন্যাও
বেশ লাভবান হচ্ছে। কারণ তার উপর কোনো রকম ব্যয়ভার থাকে না, বরং পুরোটাই তার পুঁজি। পুরোটাই সে সঞ্চয় করতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগও করতে পারে। বিপদ-আপদে সেই অর্থ-সম্পদ তার জন্য অনেক উপকারী হয়।
পুত্র-কন্যার প্রাপ্যাংশের পার্থক্যের পেছনে হয়তো এই প্রজ্ঞা ও হিকমতই রয়েছে। শুধু এই বিশেষ ক্ষেত্রেই নারী পুরুষের তুলনায় কম অংশ
লাভ করে। বহু ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর প্রাপ্যাংশ অধিক। উত্তরাধিকারের বিষয়াদি ও তার বিভিন্ন রূপরেখা পর্যালোচনা করলে বিষয়টি
আরও স্পষ্ট হয় যে-
(ক) চারটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অর্ধেক অংশ পায়।
(খ) বেশ কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর অংশ একদম সমান থাকে।
(গ) দশ বা তার থেকেও বেশি ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি অংশ পায়।
(ঘ) কিছু ক্ষেত্রে এমনও আছে, যে গুলোতে কেবল মহিলারাই অংশ পায় এবং পুরুষ বঞ্চিত হয়।
আরও সহজ করে বলা
যেতে পারে যে, ত্রিশ বা তার থেকেও বেশি ক্ষেত্রে মহিলা পুরুষের সমান অংশ পায়, অথবা তার থেকে বেশি পায়, অথবা মহিলা
উত্তরাধিকারী অংশ পায়, কিন্তু সমস্তরের পুরুষ
উত্তরাধিকারী বঞ্চিত হয়। অপরপক্ষে শুধুমাত্র চারটি ক্ষেত্রে মহিলা
উত্তরাধিকারী পুরুষ উত্তরাধিকারীর অর্ধেক পায়। ফারায়িয (উত্তরাধিকার বণ্টন
সংক্রান্ত ইসলামি নীতিমালা) বিদ্যার বিষয় ও ক্ষেত্রগুলি পর্যালোচনার এটা প্রমাণিত
ও স্পষ্ট যে, ইসলামে উত্তরাধিকার বণ্টনের মানদণ্ড
উত্তরাধিকারীর পুরুষ বা নারী হওয়া নয়; বরং সে-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উত্তরাধিকারী
ও মৃতের সম্পর্ক, নৈকট্য, দায়দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলি।
নারীর উত্তরাধিকার ও বর্তমান
মুসলিম সমাজ
ইসলামে নারীর উত্তরাধিকার
সূত্রে প্রাপ্য অংশ নির্ধারিত। তা সত্ত্বেও বর্তমানে মুসলিম সমাজে নারীর উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ প্রাপ্তির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিছু ক্ষেত্রে যৌতুক দেওয়ার দরুন পিতা তাকে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করে দেয়। আবার কখনো কন্যাদান (জামাই ও মেয়ে বিদায়) এর রীতির প্রভাবে তার বিয়েতে যাবতীয় খরচের অজুহাত দেখিয়ে তাকে তার প্রাপ্য সম্পদ হতে বঞ্চিত করা হয় (যদিও ছেলের বিয়েতেও অনুরূপ অর্থ ব্যয় হয়, কখনো তার দ্বিগুণ খরচ হয়,
তবে তার ক্ষেত্রে অমন কোন উদ্ভট যুক্তি দেখানো হয় না)। আবার অনেক সময় সুসম্পর্ক বজায় রাখার দোহাই দিয়ে পিত্রালয়ে তার আসা যাওয়ায় কোন অসুবিধা
যেন না হয়, এমনকি সুখে দুঃখে ভাইয়েরা পাশে দাঁড়াবে
এই প্রলোভন দেখিয়ে তাকে
তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই মনোভাব থেকেই হয়তো জন্ম নিয়েছে উর্দুর এই প্রবাদটি ‘লাড়কিয়া পারায়ে ঘর কি হোতি হ্যাঁয়’।
তাছাড়া মাবাবারা মেয়ের বিয়ের সময়
আজকাল মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকেদের অনেক কিছু দিতে বাধ্য হয়। পণের ঋণ পরিশোধ করতে
গিয়ে মেয়ের বাবার নাজেহাল অবস্থা আজ মুসলিম সমাজেও। সেই সূত্র ধরে বাবারা
মেয়েদেরকে তাদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে এই বলে যে, তাকে সে বিয়েতে অনেক কিছু
দিয়েছে! এমন বঞ্চনার নানান ঘটনা প্রায়শই
ঘটতে দেখা যায়।
উত্তরাধিকার কেন্দ্রিক কলহ
ভারত একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। নানা সংস্কৃতির সমাবেশক্ষেত্র। এখানে হিন্দু, মুসলিম, জৈন, খ্রিষ্টান সকলে বাস করে।
সবাই নিজেদের আদর্শ ও ধর্মমত অনুযায়ী জীবন যাপন করে। বহু বিষয়ে, বহু ইস্যুতে সবার
অবস্থা প্রায় একই রকম। বিশেষ করে, নারী সংক্রান্ত ইস্যুগুলিতে। তবে উত্তরাধিকার-বণ্টনকে কেন্দ্র ক’রে মারপিট, হানাহানি এমনকি খুনোখুনি ও মামলা মুকদ্দমা আদালতে সব থেকে বেশি মুসলিমদেরই পাওয়া যায়। আর এর কারণ
হচ্ছে মুসলিমদের অশিক্ষা, অসচেতনতা এবং ধর্মবিমুখতা। তাই এসব সমস্যা
ও সংকট থেকে নিস্তার পেতে সমাজকে সচেতন হতে হবে নারী-কেন্দ্রিক প্রতিটি ক্ষেত্রে।
নারীর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার প্রদানের যে পথ ও পদ্ধতি বাতলে দেওয়া হয়েছে, সেসব
উপায়-উপকরণ বাস্তবায়িত করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা একজন
পিতার। এবং আমি মনে করি, কোন পিতাই চান না যে তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা পরিত্যক্ত সম্পদ নিয়ে হানাহানি করুক,
মামলা-মোকদ্দমা করুক। তাই তারা এমন
সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য এবং উত্তরাধিকারীদের সুষ্ঠু জীবন যাপনের লক্ষ্যে জীবদ্দশায় উত্তরাধিকারীদের মাঝে শরিয়তের বিধি ও
সিদ্ধান্ত অনুসারে বণ্টন নামা লিপিবদ্ধ করতে পারেন। যা তাদের মৃত্যুর পর কার্যকরী হবে। এই ব্যবস্থাপনা ভারতীয় আইন সম্মতও। এবং এটি কোন ব্যয় বহুল প্রক্রিয়াও নয়। তাছাড়া ভারতীয় আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারীরা এই বণ্টন নামা মানতে বাধ্য থাকবে।
উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত করা পাপ
উত্তরাধিকারের পরিমান
যেহেতু বিধিবদ্ধ, তাই সে বিষয়ে কোন সমস্যা নেই। মেয়েদের উত্তরাদ্ধিকার থেকে বঞ্চিত করাই হল বর্তমান
সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির
একটি। অথচ মেয়েদের এই উত্তরাধিকার এই
প্রাপ্যাংশ “আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত”[13]। অর্থাৎ আল্লাহ্র তরফ থেকে নির্দিষ্ট করা একটি আদেশ। এবং কুরআনে অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, “এটা আল্লাহ্র তরফ থেকে নির্ধারিত সীমারেখা”[14]। আর আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করা
নিঃসন্দেহে এক ভয়ংকর অপরাধ। তাছাড়া একটি মেয়ে উত্তরাধিকারের যে অংশটুকু পায়, সেটা
কোন পুরুষদের দেওয়া অংশ নয়। বরং ঐ অংশটি তো মহান আল্লাহ্ তাদেরকে দিয়েছেন। অতএব সেই
অংশে কম ও বেশি করা আল্লাহ্র অধিকারে হস্তক্ষেপ করার সমতুল্য। যা নিঃসন্দেহে এক অমার্জনীয় পাপ।
উপসংহার
বর্তমানে অনেক সময় দেখা যায়, মুসলিম সমাজে বহু পরিবারে ভাইয়েরা বোনেদেরর অংশ হাতিয়ে নেয়। অনেক সময় পিতার মৃত্যুর পর বিধবা মাকেও তারা বঞ্চিত করে দেয়। আর এসব দেখে-শুনে অনেকে ইসলামের উত্তরাধিকার
সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে ভুল ধারণার শিকার হয়ে ইসলামকে আক্রমণ করে বসে। অনেকে এসব
বঞ্চনা দেখে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এসবের বিচার বিশ্লেষণ করে এবং উত্তরাধিকার বণ্টনের
প্রজ্ঞাময় ও যুক্তিসম্মত নীতিমালাকে লিঙ্গ বৈষম্যের কাঠগড়ায় দাড় করায়। আর এসব
কারণে উত্তরাধিকারে সমতার জিগির তুলে চারপাশে যেসব অপপ্রচার চলছে তার প্রতিউত্তর ও
সমাধান মুসলিম সমাজকেই করতে হবে। মুসলিম নারীদেরকে নিজ অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে এবং নারী পুরুষ উভয়কে বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ
করতে হবে। * অধ্যাপক, গভঃ গার্লস জেনারেল ডিগ্রী কলেজ, কলকাতা
[1] কুরআনে ‘নিসা’ অর্থাৎ
মহিলা শব্দটি ৫৭ বার এবং ইম্রাআহ্’ অর্থাৎ নারী শব্দটি ২৬ বার উল্লেখ হয়েছে।
তাছাড়া পবিত্র কুরআনে ‘আন্-নিসা’ শিরোনামে নারীর অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত একটি
বৃহৎ সূরাও আছে।
[2] হুক্বুক্বুল্ মার্আহ্ ফিল্ ইসলাম, আব্দুল ক্বাদির শায়বাতুল্ হাম্দ, (৪৮১৫-০০১-৬০৩-৯৭৮), পৃষ্ঠা ৯-১২
[3] হুক্বুক্বুল্ মার্আহ্ ফিল্ ইসলাম, আব্দুল ক্বাদির শায়বাতুল্ হাম্দ,পৃষ্ঠা ২২-২৩, তির্মিযি ১১৬৩ (ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে
সহিহ বলেছেন।)
[5] সহিহ বুখারি, সহিহ
মুসলিম ও সুনান কুব্রা-তে ‘কিতাবুল্ ফারায়িয’, জামে’ তির্মিযি-তে কিতাবুল্ ফারায়িয ‘আন রাসুলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সালাম’ নামে
[9] মু’জামু মাক্বাইসিল্ লুগাহ্, ইবনু ফারিস ৪/২৪৬, লিসানুল্ ‘আরব ১১/৪৩০, আল্-মুসাওয়াত আল্-‘আদিলাহ্ বায়নাল্ জিন্সাইনি ফিল্ ইসলাম, ১৫১
[Proceedings: WOMEN RIGHTS IN ISLAM International Conference 5-6 February 2019 (ISBN- 81-88-792-53-5) Organized by Department of Arabic, Islamic Theology & Islamic Studies, Aliah University In association with Huda Educational & Welfare Trust, Uttar Dinajpur, WB-এর ২০৬-২১১ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment