আল্-কুর্আনঃ সংকলন ও সংরক্ষন
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
অধ্যাপক, গভঃ গার্লস
জে ডিগ্রী কলেজ, কোলকাত
আল্-কুর্আন ইসলামি সাহিত্যের মূল
উৎস। আরবি ভাষায় সংকলিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। আরবি গদ্যের সূচনাকারী। এমনকি খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের শিক্ষা ও সাহিত্যমূলক
নব-জাগরনের মূলমন্ত্র।
আল্-কুর্আন শব্দটি ক্বারাআ শব্দের
বিশেষ্য। এর অর্থ বারবার পাঠ
করা। পরিভাষায় আল্-কুর্আন বলতে আমরা বুঝি যে আসমানি গ্রন্থটি নবি মুহাম্মদ (সা)-এর
উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে পরিভাষাবিদগণ
বলেছেন- “আল্-কুর্আন আল্লাহ্র বাণী। এর ভাব ও ভাষা উভয়ে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে
অবতীর্ণ হয়েছে, জিব্রিল মারফৎ, নবি মুহাম্মাদ সা-এর উপর, দীর্ঘ তেইশ বছরে এবং
সাহিফা (গ্রন্থ)-আকারে লিপিবদ্ধ।” [আল্-ইত্ক্বান ফি উলুমিল-কুর্আন,
আস্-সুইয়ূতীঃ ১/১৮১-১৮২]
এই মহাগ্রন্থে ত্রিশটি অংশ বা
পারাহ্ এবং ১১৪টি সূরা বা অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়টি হল সূরাতু আল্-ফাতিহাহ্
(উদ্ঘাটিকা) ও অন্তিমটি সূরাতু আন্-নাস (মানবজাতি)। আয়াত সংখ্যা ছয় হাজারের অধিক। অনেকের মতে, ৬৬৬৬টি। কিন্তু আধুনিক গবেষকরা মনে করেন, ৬২৩৬টি আয়াত রয়েছে আল্-কুর্আনে। [আল্-ওয়াযিহ্ ফি উলুমিল্-কুর্আন,
আল্-বুগা ও মাস্তুঃ ১৫-২১]
অবতরণের পূর্বে
অবতরনের পূর্বে আল্-কুর্আন লাওহে
মাহ্ফুয (সুরক্ষিত ফলক)-এ সংরক্ষিত ছিল। এ সম্পর্কে কুরআন নিজেই ঘোষনা করেছে- “আর
সেটি হল মহিমাময় কুরআন; যা (সংরক্ষিত) ছিল লাওহে মাহ্ফুযে।” [সূরাতু আল্-বুরূজঃ
২১-২২] “নিশ্চয় তা পবিত্র কুরআন; সুরক্ষিত
ছিল এক সংরক্ষিত গ্রন্থে।” [সূরাতু আল্-ওয়াক্বিয়াহ্ঃ ৭৭-৭৮]
অবতরণ
প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে
দীর্ঘ তেইশ বছরে আল্-কুরআনের অবতরণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম তেরো বছর মক্কায়। এ সময় ৯৩টি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। আর
হিজরতের পর মদিনায় ১০ বছর অবতীর্ণ হয়েছে ২১টি সূরা। ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমযান মাসে হেরা পর্বতগুহায় সূরা আলাক-এর
প্রথম পাঁচটি আয়াত দিয়ে অবতরণের সূচনা হয়। আর সমাপ্তি ঘোষিত হয়েছে নবি (সা)-এর
মৃত্যুর তিনমাস পূর্বে সূরা আল্-বাকারার ২৮১ নং আয়াতের মাধ্যমে। মক্কায় অবতীর্ণ দুই তৃতীয়াংশ সূরার বিষয়বস্তু দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলি। আর মদিনায় অবতীর্ণ অবশিষ্ট
সূরাগুলির বিষয়বস্তু ধর্মীয় বিধি-নিষেধ।
সংকলন ও সংরক্ষন
আল-কুরআন ইসলামি সাহিত্য ও
সংস্কৃতির উৎসমূল। তাই অবতরণের সময়েই তার সংকলন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেমন-
কিছু সাহাবা অবতীর্ণ আয়াতগুলিকে লিখে রাখতেন, আবার কেউ সেগুলিকে মুখস্থ করতেন।
পরবর্তী যুগেও এ বিষয়ের প্রতি বেশ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নিম্নে পর্যায়ক্রমে তার
বিবরণ প্রদত্ত হল।
(ক) রাসূল সা-এর যুগে
বিভিন্ন পটভূমিকায় ও নানা ক্ষেত্রে
দীর্ঘ তেইশ বছরে অল্প অল্প করে কুরআনের অবতরণ সম্পন্ন হয়। রাসূল সা নিজ জীবদ্দশায়
আয়াতগুলিকে সাজিয়ে সূরাগুলিকে সম্পূর্নরূপে সংকলনের ব্যবস্থা করে গেছিলেন, কিন্তু
তিনি এগুলিকে কোন একটি মুস্হাফে একত্রিকরনের ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। তাঁর
মৃত্যুর সময় সেগুলি গাছের ছালে বা চামড়ায় লিপিবদ্ধ ছিল। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক আহ্মাদ
হাসান যাইয়াত বলেছেন-
“মৃত্যুর পূর্বে তাঁর জীবদ্দশায়
সূরা ও আয়াত-সংকলনের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছিল; তবে সেগুলি কোনো এক গ্রন্থে একত্রিত
করা সম্ভব হয়নি। তাই রাসুল সা যখন মৃত্যু বরণ করেন, তখন কুরআন হয় লিপিবদ্ধ ছিল
চামড়া বা গাছের ছালে; নয়তো সুরক্ষিত ছিল সাহাবাদের স্মৃতিপটে।” [তারিখুল আদাবিল
আরাবীঃ ৯২]
(খ) ১ম খলিফা আবু বাক্র রা-এর
যুগে
ইয়ামামার যুদ্ধে সত্তর জন কুরআনের
হাফিজ শহীদ হওয়ায় মুসলমানদের মনে বিশেষত উমার রা–এর মনে আশংকার মেঘ ঘনীভূত হয়, কুরআন-এর হাফিজগণ এভাবে নিহত
হতে থাকলে একদিন কুরআন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তিনি ১ম খলিফা আবু বাক্র রা-কে
কুরআন সংকলনের পরামর্শ দেন। কিন্তু ১ম খলিফা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তিনি উমারকে বলেন-
“যে কাজটি রাসুল সা নিজে করেননি,
আমাদেরকে যে বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি, কীভাবে আমি সে-কাজটি করতে পারি ! ” [তারিখুল
আদাবিল আরাবীঃ ৯২]
অবশেষে উমার রা-এর যুক্তির কাছে
মাথা নত করে অহী-লেখক যায়দ বিন সাবিতের তত্ত্বাবধানে কুরআন সংকলনের আদেশ দেন।
(গ) ৩য় খলিফা উসমান রা-এর যুগে
আবু বাক্র রা কর্তৃক সংকলিত সহীফাগুলি
উসমান রা-এর শাসনামলে মা হাফ্সা রা-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। যখন ইসলামি সাম্রাজ্য
বিস্তার লাভ করল, আল-কুরআনের হাফিজগণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেন,
তখন তাঁদের মধ্যে কুরআন পড়ার ভাব-ভঙ্গিতে মতানৈক্য দেখা দিল। আর এ নিয়ে তাঁদের অনেকে অহংকার করতে আরম্ভ করল। উসমান রা ভয় পেলেন যে, তাঁরা আল-কুরআনের ভাবার্থ নিয়ে
মতোবিরোধ না করে বসে। তাই তিনি কিছু সাহাবাকে কুরাইশদের ভাষাশৈলীর উপর ভিত্তি করে
কুরআন সংকলনের আদেশ দিলেন। এ সম্পর্কে যাইয়াত বলেছেন-
“যখন সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত
হল, হাফেযেরা ছড়িয়ে পড়লো ভূখণ্ডের নানা প্রান্তে, তখন তাঁদের পাঠশৈলীতে মতবিরোধ
দেখা দিল...। উসমান রা ভয় পেলেন, ওরা পাঠশৈলীর মতো কুরআনের ভাব অ অর্থ নিয়েও
বিতর্ক ও মতবিরোধ না করে। তাই তিনি যায়েদ বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের,
সায়িদ বিন আল-আস আব্দুর রাহ্মান বিন আল-হারিস বিন হিশাম প্রমুখকে
(কুরাইশ-পাঠশৈলীর অনুকরণে সংকলনের) দায়িত্ব দিলেন।” [তারিখুল আদাবিল আরাবীঃ ৯২-৯৩]
অতএব আল-কুরআন কুরাইশদের
ভাষাভঙ্গিতে অবতীর্ন হওয়ায় তাঁরা উক্ত ভাষার ওপর ভিত্তি করেই সকল সহীফাকে একটি মুস্হাফে
সংকলন করলেন। আর সূরাগুলিকে ত্বুল-ও-ক্বাস্র (দীর্ঘ-সংক্ষিপ্ত) রীতি অনুসারে
সাজালেন। অতঃপর খলিফা উসমান রা
ছয়টি পান্ডুলিপি তৈরী করে ছয়টি প্রদেশে প্রেরন করলেন। আর মূল পান্ডুলিপিটি মদিনাতেই
রেখে দিলেন। তারপর অন্যান্য সাহিফাগুলিকে
জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ করলেন। এ সম্পর্কে যাইয়াত বলেছেন-
“অতঃপর প্রতিটি প্রান্তে একটি করে
পাঠালেন। মোট সাতটি; একটি করে মক্কা, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহ্রাইন, বাস্রা ও কুফাতে
পাঠালেন। আর একটি মদিনাতেই রেখে দিলেন; এই মুস্হাফটিকে ‘ইমাম’ বলা হয়। অতঃপর
বাকিগুলিকে জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন।” [তারিখুল আদাবিল আরাবীঃ ৯২-৯৩]
[পূবের কলম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, দীনদুনিয়া-য় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment