হাদিস সংকলনঃ
একটি দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
হাদিস – ইসলামি সাহিত্য ও সংস্কৃতির দ্বিতীয় প্রধান উৎস। কুর্আনের সুনিপুণ ও
নির্ভরশীল ব্যাখ্যা। নবি মুহাম্মদ (সা)-এর কর্ম ও আদর্শের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। আভিধানিক
অর্থ- নতুন। আর পরিভাষায়, নবি সা-র এমন সকল কথা, কাজ ও মৌনসমর্থন যা রাসুল (সা), সাহাবা
(রাসুল সা-র সহচরবৃন্দ) ও তাবেয়িনদের (যে মুসলিমেরা কোনো সাহাবির সাক্ষাৎ লাভ
করেছেন) থেকে বর্ণীত। শরিয়তের দৃষ্টিতে, কুরআনের মতো হাদিসও প্রামাণ্য। কারণ কুরআনের সংক্ষিপ্ত তত্ত্বাবলীর সুনিপুণ ও নির্ভরশীল ব্যাখ্যা কেবল হাদিসেই রয়েছে। যেমন- কুরআনে স্বালাত আদায়ের আদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পদ্ধতি, সময়, শর্তাবলী কোনও কিছুরই আলোচনা করা হয়নি। সময়সূচী থেকে
নিয়ে আদায়ের পদ্ধতি সমস্ত কিছুই সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে হাদিসে। তাই মুসলমানদের জন্য হাদিসের অনুসরণ অপরিহার্য। [আল-মায়েদাহ্
৯২, আন্-নিসা ৮০, মুসলিম ১৮৩৫] তাই প্রায় সব যুগেই মুসলিম ও বহু অমুসলিম পণ্ডিত
হাদিসের বর্ণনা, ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ, সংকলন ও বর্ণনা-শৃঙ্খলের প্রতি গুরুত্বারোপ
করেছেন।
হাদিস-সংকলন রাসুলের যুগে
নবি (সা)-এর জীবদ্দশায়, তাঁর সহচরবৃন্দ (যেমন- আবু হুরায়রা
রা) অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে হাদিস মুখস্ত করতেন। আবার অনেকে (যেমন- আলি, ইব্নে উমার, ইব্নে
আব্বাস, আনাস বিন
মালিক, ইব্নে আম্র (রা)) নবি (সা)-র অনুমতি সাপেক্ষে লিখেও রাখতেন। এভাবে কিছু
হাদিস স্মৃতিপটে আবার কিছু লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল। আবূ হুরায়রা (রা) প্রায়শই
বলতেন- “আবদুল্লাহ্
ইব্নে আম্র ছাড়া আর কোনো সাহাবি আমার থেকে বেশি হাদিস জানে না। কারন, তিনি হাদিস লিখে রাখতেন আর আমি
লিখে রাখতাম না।” [সহিহ্
বুখারি ১১৩] উল্লেখ্য যে, আল-কুরআনের সাথে হাদিস সংমিশ্রণ হওয়ার আশংকায় সে-সময়ে
হাদিস সংকলনের কাজ সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে আবূ বাকর (রা)-এর আমলে কুরআন
গ্রন্থাকারে সংকলিত হবার পরে হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে সাহাবি ও তাবেয়িগণ
প্রয়োজন অনুসারে হাদিস-সংকলন আরম্ভ করেন।
উমার বিন আব্দুল আযিযের যুগে
ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাদিস সংকলনে অনেকের অবদান রয়েছে। তবে সরকারীভাবে
সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেন উমার বিন-আব্দুল আযিয (রাহ)। মদিনার
শাসনকর্তা আবু-বাক্র বিন-হায্ম সহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য শাসনকর্তা ও ওলামাদের
(ইসলাম-বিশেষজ্ঞদের) নির্দেশ দেন, হাদিস ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহন না-করার এবং মজলিস
প্রতিষ্ঠা করে হাদিস শেখানোর। তাঁর আহ্বানে সর্বপ্রথম
সাড়া দেন ইবনে শিহাব যুহরি (রাহ)। তাই তিনি গর্ব করে বলতেন- “আমার পূর্বে কেউই এই শাস্ত্রকে
সংকলন করেনি”। তবে তাঁর সংকলিত হাদিস গ্রন্থটির বর্তমানে কোন সন্ধান
পাওয়া যায়না। [ফাত্হুল বারী ১/২০৮]
আব্বাসি যুগে
অন্যান্য শাস্ত্রের ন্যায়
হাদিস-চর্চার পথও প্রশস্ত হয় এযুগে। নানান অঞ্চলে শুরু হয় সংকলনের কাজ- মক্কায়
ইমাম ইবনে জুরাইয, মদিনায় ইমাম মালিক ও মুহাম্মদ বিন ইস্হাক, মিসরে লায়স বিন
সাআদ, খোরাসানে আবদুল্লাহ্ বিন মুবারক, কুফায় সুফিয়ান সাওরি, বসরায় হাম্মাদ ইবনে সালমা, সিরিয়ায় ইমাম আওযায়ি এবং
ইয়েমেনে মুয়াম্মার বিন রাশেদ (রাহ্)। তাঁরা সকলে
দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় হাদিসগুলি স্থানীয় হাদিস-শিক্ষাকেন্দ্র থেকে সংকলন
করেছিলেন। তবে বিষয়বস্তুর আদলে বিন্যাস করেননি। এযুগে সংকলিত ইমাম
মালিকের “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম ও প্রমান্য। কেবল
এ-গ্রন্থটিরই সন্ধান পাওয়া যায়। আর এযুগে হাদিসের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাহাবা ও তাবেয়িনদের ফাত্ওয়াও (সিদ্ধান্ত ও মতামত) সংকলন করা
হতো।
‘মুস্নাদ’ –সংকলন
‘মুয়াত্তা’ গ্রন্থটি হাদিস সংকলনের ব্যপারে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা
সৃষ্টি করে। ফলে মুসলিম বিশ্বে সর্বত্রে হাদিসচর্চার কেন্দ্র স্থাপিত হতে থাকে।
তবে এসময়ে অন্য কারুর ফাত্ওয়া ছাড়াই শুধুমাত্র হাদিস সংকলন করা হতো। আর এধরণের গ্রন্থ
সর্বপ্রথম রচনা করেছিলেন আবু দাউদ ত্বায়ালেসি। ইমাম
শাফেয়ির ‘কিতাবুল্-উম্ম’ এবং ইমাম আহ্মাদ বিন হাম্বলের ‘মুস্নাদ’ এসময়ের এবং
এধরণেরই সংকলন।
হাদিস-সংকলের
স্বর্নযুগ
হাদিস সংকলনের যে-কাজটি নবি (সা)-এর সময়ে স্মৃতিপটে
সংরক্ষণের মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছিল, তা সময়ের আবর্তনে লিখিতরূপে সংরক্ষণের রূপ ধারণ
করে এবং ধীরে ধীরে আব্বাসি যুগে হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে পূর্ণতা লাভ করে। এসময়ে মুসলিম
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ
ব্যাপকভাবে আরম্ভ হয়। এসময়েই সংকলিত হয় সহিহ্ বুখারি, সহিহ্ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, জামে’ তির্মিযি, সুনান নাসায়ি এবং সূনান ইবনে মাজাহ্। সম্মিলিতভাবে
এগুলোকে সিহাহ সিত্তাহ্ বা কুতুবে সিত্তাহ্ (ছয়টি বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থ)
বলা হয়।
[দৈনিক পূবের কলম, ***-এ প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment