Sunday 16 June 2019

বদিউর রহমানঃ ছোট দাদী


নেই বলে তাই খাচ্ছ; থাকলে কোথায় পেতে!” এই জাতীয় প্রবচন শুনতাম ছোট দাদীর মুখে মগলামপুরের রাজকীয় দালানবাড়ীর (১৯০১ সালে তৈরী) বার-বারান্দায় চৈত্র-বৈশাখের গরমের সন্ধ্যায় লম্বা করে পাতা বিছানায় শুয়ে খোলা আকাশের তারামণ্ডলী দেখাতে দেখাতে ছোটদাদী শোনাতেন ঐ জাতীয় কথা জিজ্ঞাসা করতেন তার সমাধান স্বভাবতই আমরা ছিলাম অপারগ তখন সুন্দর করে বলতেন বিভিন্ন গল্প, আখ্যান, ক্যাপশনে উল্লেখিত প্রবচন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “একটা গরুর লেজ কেটে গিয়েছিল, তার পিঠের পিছনের দিকে হয়েছিল একটা ঘা তার উপর মাছিদের চলত অবিরাম অত্যাচার গরুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতঃ তার লেজ নেই বলে মাছিরা অবলীলায় ঘায়ের উপর বসে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করছে; তাকে উত্যক্ত করে চলেছে; যদি তার লেজটুকু থাকত তাহলে মাছিদের পক্ষে ঐভাবে বিনা বাধায় ঘায়ের উপর বসে তার উপর অত্যাচার চালান সম্ভব হত নাগরুর মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা ব্যক্ত করে উক্ত প্রবচন গ্রামীণ চালচিত্র ও জনজীবনের রূপরেখা উন্মোচনে ঐ জাতীয় প্রবচন, ধাঁধা ইত্যাদির গুরুত্ব অপরিসীম ছোট দাদীর কাছে সেগুলো শুনতে উদগ্রীব থাকতাম প্রচণ্ড গরমে মগলামপুরের ঐ বারান্দায় শুয়ে আছি সেবার বৈশাখের দীর্ঘ দশ-পনের দিনের মধ্যে একটাও কালবৈশাখীর দেখা নেই সকলে গরমে হাঁসফাঁস করছ আমরা যারা ছোট দাদীর  চারপাশে শুয়ে আছি তাদের প্রত্যেকের হাতে তালপাতার পাখা তার মধ্যে কিছু পাখা আবার নাগাড়ে ঘোরানো যায় দাদী আমাদের মধ্যমণি বলে তাঁকে দুপাশ থেকে দুজন হাওয়া করছি দাদী বললেন, “দুনিঃশ্বাসে চল্লিশটা জায়গা অথবা গ্রামের নাম বলতে হবে যার শেষেপুরশব্দটা থাকবে বলতে সক্ষম হলে দুদিনের মধ্যে বৃষ্টি নামবেগরম কমবেসকলে উঠে পড়ে লাগলাম সেই রকম গ্রামগঞ্জের নাম গুনতে আমাদের ছোটবেলার জগতটা ছিল ছোট তাই বিশাল পৃথিবীর সংকীর্ণ পরিচিতি নিয়ে গুনতে শুরু করতামঃ তাতারপুর, রসুলপুর, বাসুদেবপুর, বৈদ্যিপুর, আলিপুর, ভেজানপুর ইত্যাদি সকলের মিলিত প্রচেষ্টাতেও আঠার-বিশটার বেশি রকম জায়গার নাম শোনাতে সক্ষম হইনি আর ঐ ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে কখন যে চলে যাই ঘুমের দেশে জানতেও পারিনি প্রায় দুরাত্রি ছোট দাদি আমাদের সুযোগ দিয়েছিলেন তা সত্ত্বেও আমরা সেরকম চল্লিশটা জায়গার নাম শুনিয়ে দিতে সক্ষম হইনি অস্বাভাবিক গরমেও ঘুমের দেশে পাড়ি দিতে কোনো কষ্ট হয়নি, শুধুমাত্র নাম গোনায় মনোনিবেশ করতে গিয়ে সৌভাগ্যবশতঃ, তৃতীয় রাত্রিতে ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন আর বার-বারান্দায় শোওয়া হয়নি সেদিন দাদীর দেখানো শুকতারা, কালপুরুষ ইত্যাদিদের দর্শন থেকে বঞ্চিত হই তবে বিভিন্ন ঘরে না শুয়ে দাদীকে আমরা বাধ্য করি ভিতর বারান্দায় লম্বা বিছানায় শুয়ে গল্প শোনাতে কত গল্প শুনেছি; কিছু মনে আছে, কিছু আবছা মনে পড়ে গল্পগুলোর মধ্যে চাষীর বৌ, লাঙলের অশ্রু, পাঁচনবাড়ি, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, চাঁদের বুড়ি ইত্যাদি হালকা হালকা মনে পড়ে বহু ধাঁধার মধ্যে তাঁর মুখ থেকে শোনা একটা ধাঁধার কথা উল্লেখ করছি—“বন থেকে বেরলো হুমো, তার গায়ে ডুমো ডুমোসেটা যে আনারস, তা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ছোট দাদী

ছোটদের প্রতি ঐ দাদীর ছিল অশেষ স্নেহ তাঁর মধ্যেও ছিল শিশুসুলভ ছেলেমানুষী ও সারল্য দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দাদীর সঙ্গে চলত লুডু খেলা কার সাধ্যি দাদীকে হারায়! কখন হাতসাফাই করত আমরা ধরতেই পারতাম না তবুও ওনাকে ছাড়া লুডু খেলা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না

ছোট দাদা ছিলেন পাণ্ডুয়া রাইস মিলের ক্যাশিয়ার দাদীর হাতে মাসিক কত টাকা দিতেন জানিনা; কিন্তু দাদী ছিলেন বাচ্চাদের জন্য দরাজ হস্ত তখনকার দিনে বেলা দশ-এগারোটায় বাঁক কাঁধে আসত এক বয়স্ক উড়ে খাবারওয়ালা তার বাঁকের একটা ঝুড়িতে থাকত নোনতা খাবার আর অন্যটাতে মিষ্টি দ্রব্যাদি আমাদের দালানবাড়ির সিংহদ্বারে হাঁক দেওয়া মাত্র ছোট দাদী আমাদের বলতেন, “যাও ওর কাছে, আর যার যা খাবার পছন্দ নিয়ে এসোসব পয়সা মেটাতেন মেজদাদী আর ছোটদাদী ওনাকে বলতেন, “বুন, আমিই তো বাচ্চাদেরকে মালির কাছে পাঠালাম; আজ না হয় আমিই দামটা মিটাতামওই কথাটার মধ্যে একটা করুণ ব্যথা আমার বুকে শেল হয়ে বিঁধেছিল মনে হয়েছিল তুলনামূলকভাবে বেশী সচ্ছল মেজদাদী কি ছোটদাদীর উপর করুণা করলেন বলে ছোটদাদীর ব্যথা! অথচ দুই দাদীর মধ্যে ছিল অপূর্ব সখ্যতা ও মেলবন্ধন। মায়ের কাছে শুনেছি যে তখন ওনারা মগলামপুরেই থাকতেন। আব্বা সেখান থেকে মোটরসাইকেলে পাণ্ডুয়ায় চেম্বার করতে আসতেন। বড়ভাইয়ের জন্য আব্বা একটা প্যারাম্বুলেটর কিনে দিয়েছিলেন। একদিন রান্নাশাল থেকে মা দুই দাদীর অট্টহাসি শুনে মুখ বাড়িয়ে দেখেন যে বড়ভাইয়ের সেই প্যারামে ছোটদাদী বসে আছেন আর মেজদাদী তাঁকে বার-বারান্দায় ঘোরাচ্ছেন—আর দুজনে হাসিতে ফেটে পড়ছেন। দাদীর অনেক কীর্তিকলাপই ছিল সেরকম।

ছোট দাদীর সংসার ছিল একমাত্র সন্তান মহম্মদ আজেম, তার স্ত্রী ও তাদের দুই সন্তান-সন্ততি নিয়ে। আর মেজদাদি ছিলেন নিঃসন্তান। আজেম চাচার দুই ছেলেকে (আবু, আফতার) তিনি মানুষ করেন। মেজদাদা ছিলেন কড়া মেজাজের আর ছোটদাদা ছিলেন একেবারেই তার বিপরীত নরম প্রকৃতির। ছোটদাদাকে পাণ্ডুয়ায় তাঁর ধর্মভীরুতার জন্য সকলে সুফি সাহেব বলতেন রাজ্জাকিয়া রাইসমিলের অনতিদূরে আমাদের পাণ্ডুয়ার বাড়িতে তিনি প্রায়ই আসতেন টুক টুক করে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে জাহানারা বুবুকে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন তাঁকে অনেক দোয়া দরূদ শেখাতেন তিনি অনেকবার আমাকে সঙ্গে করে পাণ্ডুয়া থেকে মগলামপুর নিয়ে গিয়েছেন তখনকার দিনে চূঁচূড়া-বৈঁচি বাস চলত বৈঁচিতে নেমে দাদার সঙ্গে প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছতাম মগলামপুর দাদীরা রান্নাশালে আদর করে রান্নার মাঝে হাত ধোয়ার গামলাতে হাত ডুবিয়ে ভিজে হাতটা দিয়ে আমার মুখে বুলিয়ে পরনের কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলতেন, ‘আমার ধনেরা এসেছেসেই স্নেহ আর কারও কাছে পাইনি ঘরের উঠানে পাকা কুঁয়াতলায় স্নান করানোর আগে সমস্ত কাপড় খুলে দিয়ে এক পলা সরষের তেল মাখিয়ে স্নান করানোর স্মৃতি আজও ভুলিনি বিশেষ করে শীতকালে আমার গালের ফাটাগুলোতে সরষের তেলের স্পর্শ এক ধরণের জ্বালা সৃষ্টি করত তা আজও অনুভব করি

আমাদের স্নান করার সময় ছোটদাদা জোহরের নামাজের পর বাড়ি ফিরে ভাত খেতে চাইতেন ছোটদাদীকে অনেকদিন বলতে শুনেছি, “আ মোলো যা! এই সাতসকালে ভাত খাবে? কটা বাজে কটা?” দাদা বলতেন, “কেন! জোহরের নামাজ হয়ে গেল আর বলিস কটা বাজে?” দাদী বলতেন, “দরদালানে ঘড়িটা দেখ কটা বাজেভালমানুষ ছোটদাদা দরদালানের দেওয়াল ঘড়িতে দেখতেন বারোটা পনেরো বা কুড়ি!! আসলে কারচুপিটা আগে থেকে করে রাখতেন ছোটদাদী

আমার নিজের দাদা-দাদীকে কখনো দেখিনি কিন্তু ওই দাদা-দাদীরা তাঁদের অভাব বুঝতে দেননি নিঃসন্তান মেজদাদা কড়া মেজাজের হলে কী হবে, আমাদের সকলকে খুব ভালবাসতেন তাঁর বাড়িতে নিত্য লেগে থাকত মিলাদ ও দোয়াখানি আজেমচাচা খানা-রান্নার ডেগে রান্না চড়াতেন সবথেকে সুস্বাদু ছিল তার হাতের ঘেঁট সন্ধ্যার সময় তিনি দুখানা হ্যাচাক জ্বালাতেনআমরা ছোটরা তাকে ঘিরে ধরে হ্যাচাক জ্বালানো দেখতামমাগরিবের পর শুরু হত মিলাদ; চলত ইশা পর্যন্ততারপর গ্রামশুদ্ধ আবালবৃদ্ধবণিতা পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া সেরে যে যার নিজে বাড়ি ফিরত বেশ রাত করেআমি অবশ্য সারাদিনের উত্তেজনায় অবসন্ন হয়ে কখন যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যেতাম বুঝতেই পারতাম নাসকাল হলে সব স্বপ্ন বলে মনে হত! মেজদাদাকে সবথেকে কঠিন মানুষ বলে মনে হত তারপর যখন বলতেনতৈরী হও, পাণ্ডুয়া রেখে আসবচাইতাম অন্তত আরও দুদিন মগলামপুরে থাকিদাদা বলতেন, “পড়া কামাই হবে; বড়ডাক্তার আমাকে কথা শুনাবেতা আমি পছন্দ করি নাসুবোধ বালকের মত পাণ্ডুয়া ফিরতে বাধ্য হতামসেই নিষ্ঠুর মেজদাদা প্রতি বৎসর আমাদেরকে পাণ্ডুয়া থেকে নিয়ে আসতেন একটা বারান দেখানোর জন্যগরুর গাড়িতে বাঁধা হত ছই বারানতলা সাধারণতঃ নিয়ে যেত আদিবাসী গেড়েসেখানে পৌঁছতে পার হতে হত একটা শুষ্ক খালগরুর গাড়িটা যখন তার ঢালুতে নামত সেখান থেকে পাড়ে উঠত সেই সময়টায় গাড়োয়ানের অনর্গল হট হট হট হট এখনও শুনতে পাই

যে ছোটদাদীকে নিয়ে শুরু করেছিলাম সেই দাদীর সম্পর্কে দু-চারটে কথা বললে বিরক্ত হবেন না আশা করিতাঁর যখন বিয়ে হয় বয়স ছিল নয় কি দশতিনি মগলামপুরের পাশের গ্রাম সামলাগড়ের মেয়েবিয়ের আগে ওনার বাবা-চাচারা এসেছিলেন আমাদের বাড়িবাড়ির উঠোনটা সবদিক মিলিয়ে প্রায় একশ ফুটদাদির বাবা তাঁদের বাড়িতে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, ‘আমার মেয়েটা তো খুবই ছোট আর তাকে যদি এই বিশাল উঠোন ঝাড় দিতে হয় তাহলে তো সে অসুস্থ হয়ে পড়বে!’ দাদী তখন নিষ্পাপ শিশু, বিয়ের অর্থই বোঝে নাবাবা চিন্তিত দেখে বলেছিলেন, “বাবজি তুমি চিন্তা কোর নাআমি কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং করে এদিক সেদিক ঝাড়ু মেরে বেরিয়ে যাব, কেউ ধরতেও পারবে নাযথারীতি বিয়ে সম্পন্ন হলদাদা শ্বশুরবাড়ি জোড়ে গেছেনপুকুরে স্নান করার সময় দু-চারটে ইঁটের টুকরো দাদার আশেপাশে পড়লে তিনি সচকিত হয়ে লক্ষ্য করেন কে যেন একটা তালগাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ইঁট ছুঁড়ছেপুকুর থেকে উঠে সেদিকে ধাওয়া করলে দেখেন কাণ্ডটা তাঁর সদ্যবিবাহিতা বালিকাবধূরসেই ছোট্ট বধূ ধীরে সংসার ধর্মের কাজ শিখলেন; সন্তান মানুষ করলেন, তার বিয়ে দিয়ে বউ আনলেন এবং ছেলে-বউয়ের সন্তানদের দেখাশোনা করে গেলেন পরম শান্তিতেকারোর প্রতি কোনরকম অভিযোগ-অনুযোগ ছাড়াশুধু ঘরের ছেলেমেয়েদের কেন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সন্তানসন্ততিদেরও করতেন অশেষ স্নেহবাচ্চাদের দুধের দাঁত নড়লে দাদী একটা সুতো দিয়ে ‘কট’ করে সেটা তুলে দিতেন। কত বাবা-মা আসত তাদের মেয়েদের নাক-কান বিঁধাতে। প্রচণ্ড গরমে ব্লাউস না ব্যবহার করে বুকের দিকে কাপড়টা ভাল করে ঢেকে রাখতে গিয়ে পিঠটা উদোম করে ফেলতেন। ছোটদাদা তেমনটা দেখলে হঠাৎ করে পিছন থেকে পিঠের উপর দিতেন আচমকা এক চপেটাঘাত। দাদী হকচকিয়ে গিয়ে বলতেন, “মাটিভরা! কে লা! মরণদশা!” উত্তরে দাদা বলতেন, “গায়ে মাথায় কাপড় দিতে শিখলে না? মেজভাবিকে দেখে শেখ; তিনি তো তোমার মত বেহায়া নন।”

সত্যি ওনারা দুই জা-ই মোটেই বেহায়া ছিলেন না। তাদের জগতটা ছিল মগলামপুরের বাড়ি আর (জামনার কাছে) টোলা, বৈদ্যপুরের কাছে পাতিলপাড়া ও আমাদের পাণ্ডুয়ার বাড়ি। প্রয়োজনে, বিয়েশাদীতে বা কারও মৃত্যুতে ওনাদের সেই সব জায়গায় ছিল যাওয়া-আসা। দুই দাদীর ছিল দুই রঙের অদ্ভূত ধরণের বোরকা। মেজদাদীরটা নীল ও ছোটদাদীরটা গোলাপী। সেগুলোর মাথার দিকটা ছিল গোল টুপির মত। চোখের জন্য দুটো গোল গোল নেট। মুখের নেকাব কখনও সরতো  না। তাঁদের কোথাও যাওয়ার ব্যবস্থা হত ছৈ ওয়ালা গরুর গাড়ি, তাও আবার সামনে পিছনে কাপড় টাঙিয়ে পর্দা করা। ১৯৫২ সালে আমাদের পাণ্ডুয়ার রওযাপাড়ার বাড়িতে ডাকাতির খবর শুনে তাঁরা তৎক্ষণাৎ পৌঁছে গিয়েছিলেন পাণ্ডুয়া, আমাদের দুঃসময়ে আমাদের পাশে দাঁড়াতে। ওই ডাকাতির দু’দিন পর আমার জন্ম হয়। তাই আমার মায়ের সেবার জন্য মেজদাদী থেকে গিয়েছিলেন পাণ্ডুয়া। শুধু নিজেদের পরিজন কেন, গোটা পরিবারেরে সকলের সুখদুঃখে তাঁরা এগিয়ে আসতেন। ছোটচাচা ডঃ আবদুশ শুকুর-এর লন্ডনে পাঠকালীন ফটো যত্নসহকারে আজীবন শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। ঠিক যেমনটি রেখেছিলেন আমাদের বড়ভাই ডঃ রহমান-এর লন্ডনের ছবি। ছোটদাদা মারা যাওয়ার পর অভাব অনটনের কথা ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলতেন না। সেই সদাহাস্যময় ছোটদাদী দীর্ঘদিন পর ডঃ শুকুরকে মগলামপুরে পেয়ে আস্তে করে বলে ছিলেন, “ছোট ডাক্তার, যাওয়ার সময় আমায় কিছু টাকা দিও।” চাচা দিয়েছিলেন আর অপ্রত্যাশিত বেশি বেশি দিয়েছিলেন। দাদীর সেই আনন্দঘন মুখটা আজও মনে পড়ে কিন্তু জানিনা কেন নিজেকে বড় ছোট মনে হয় পরবর্তীকালে তাঁদের স্নেহের প্রতিদানে কোন সেবা করতে পারিনি বলে। সেটা কিন্তু দূর থেকে হলেও আমার আব্বা-মা চিরকাল যথাসম্ভব করে গিয়েছেন[1]

নির্মল আনন্দস্ফূর্তির প্রতীক ছোটদাদীর আর একটামাত্র ধাঁধার কথা উল্লেখ করে ইতি টানতে চাই। আপাতদৃষ্টিতে এই ধাঁধাটা ‘ভালগার’ মনে হলেও সমাধানের পর কিন্তু তা মনে হবে না। সেটা হল—
“বন থেকে বেরলো চিতি
চিতি বলে আমি তোর ভাতেই মুতি।”
আসলে সেটা হল পাতিলেবু। ছোটদাদী ছিলেন সুরসিক, সদাহাস্যময়ী ও রসে টইটম্বুর। তাঁর স্মৃতিও তাই বড় অম্লমধুর। বোধ করি, পৃথিবীর সব নানী-দাদীরাই অমন ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে, আধুনিক সমাজের আত্মীয়তার কাটাকুটির জটিল অংকে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছেন আমাদের সেই নানী-দাদীরা! 


২১-০৪-২০১৯
কোলকাতা 


[1] হয়তো তাই, তাঁরা তাঁদের আশীর্বাদধন্য হয়ে, জীবনে সফল হয়ে, আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়ে সুনামের সাথে এ পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ওঁদের সকলকে জান্নাতুল ফিরদৌস নসীব করুন। আমরা যেন ছোট-বড় সকলকে যথাযোগ্য স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে  সুন্দর এবং পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে এই পৃথিবী ত্যাগ করতে পারি।

1 comment:

  1. শব্দ চয়ন এবং বর্ণনার পরিমিত পরিসরে সাধারণ কথাগুলো অসাধারণ হয়ে যায়। এই লেখাটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

    ReplyDelete