বৃক্ষরোপণ ও নবী মুহাম্মদ (সা)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
বৃক্ষরোপণ একটি পুণ্যময় কাজ— হাদিস শাস্ত্রের নানা গ্রন্থে একাধিক হাদিস বর্ণীত হয়েছে উদ্ভিদ জগতের নানা
বিষয়ে। কোথাও ইসলামে
ফলদ বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে বিশেষ পুণ্যময় কাজ ‘সাদ্ক্বাহ্ জারিয়াহ্’
(অবিরত
দান) রূপে
আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করে, তাহলে
ওই গাছটি যত দিন বেঁচে থাকবে এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু যত দিন তার ফল বা উপকার
ভোগ করতে থাকবে, ততদিন ওই ব্যক্তির আমলনামায় (কৃতকর্মের তালিকায়) পুণ্য লেখা হতে থাকবে। রাসূল (সা) ঘোষণা করেছেন— “যখন কোনো মুসলিম গাছ লাগায় অথবা কোনো ফসল বোনে, আর মানুষ
সহ পশু-পাখি তা থেকে খায়, তা রোপণকারীর জন্য সাদ্কা হিসেবে গণ্য হয়।” [বুখারি
২৩২০]
এমনকি ফলমূল বা ফসলের চুরি হয়ে যাওয় অংশটুকুও দান স্বরূপ গণ্য হবে। রাসুল (সা)
বলেছেন, “যখন
কোনো মুসলিম একটি ফলবান বৃক্ষের
চারা রোপণ করে,
আর
তাতে
ফল
আসার পর সে
নিজে অথবা অন্য
কোনো মানুষ তা
থেকে ভক্ষণ করে
সবই তার জন্য
সাদকা (দানস্বরূপ)। এমনকি যা চুরি
হয়ে যায়, এবং যা কিছু
অর্থাৎ খোসা, আঁটি, বীজ ইত্যাদি গৃহপালিত
পশু
এবং নানা পাখপাখালি
খায় সবই তার
জন্য সাদকা।” [মুসলিম ১৫৫৩]
শুধু তাই নয়, গাছে যত ফল হবে এবং যতদিন গাছটা বেঁচে থাকবে ততদিন ওই পরিমাণ
পুণ্য তাঁর খাতায় যোগ হতে থাকবে। রাসুল (সা) বলেছেন— “কোনো
ব্যক্তি গাছ লাগাল।
ঐ
গাছে যত ফল
হবে
তার
আমলনামায় ততো সওয়াব
(পুণ্য) লেখা হবে।”
[আল্-জামে’ আস্-সাগীর, সুয়ূতি ৮০১৬, মুস্নাদ
আহ্মাদ
২৩৪১২, ১৫৬১৬] এবং যতদিন
ঐ
গাছটা বেঁচে থাকবে,
তার
থেকে উপকার গ্রহণ
করা
হবে
অর্থাৎ “কেয়ামত পর্যন্ত
সেই
গাছ
তার
জন্য সাদ্কাহ্
জারিয়াহ্ হিসেবে গণ্য
হবে।”
[মুস্লিম ১৫৫২]
শুধু জীবিত অবস্থায় নয়, মৃত্যুর পরেও ওই রোপণকারী ব্যক্তি গাছ-লাগানোর পুণ্যফল
পেতে থাকবে। যদিও
মৃত্যুর পর মানুষের
সকল
কর্মের দরজা বন্ধ
হয়ে
যায়।
শুধু তিনটি উপায়
খোলা থাকে। নবী
(সা)
এ
মর্মে বলেছেন— “যখন
কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ
করে
তার
সমস্ত আমলের দরজা
বন্ধ হয়ে যায়
তিনটি উপায় ছাড়া।
(১)
যদি
সে
কোনো সাদ্কাহ্
জারিয়াহ্ রেখে যায়,
(২)
এমন
জ্ঞান রেখে যায়
যা
মানুষের উপকারে আসে,
(৩)
সু-সন্তান
যে
তার
জন্য ক্ষমা প্রার্থনা
করে।
এই
তিনটি ভালো কাজের
ফল
সে
মৃত্যুর পরেও পেতে
থাকবে।” [মুস্লিম ১৬৩১] উল্লেখ্য যে,
বৃক্ষরোপণ অন্যতম সাদ্কাহ্ জারিয়াহ্।
বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ— এভাবে নিজ অনুগামীদের উৎসাহিত
করার পাশাপাশি নবী (সা) নিজেও বৃক্ষরোপণ করেছেন। একদিন তিনি
(সা)
সালমান ফারসি (রা)-এর
মুক্তির জন্য তাঁর
মনিবের কাছে বার্তা পাঠালেন।
তাঁর মনিব মুক্তিপণ
হিসেবে ৪০ উকিয়া (আনুমানিক ১১৩৩.৯৮ গ্রাম) সোনা ও ৩০০
খেজুর চারা রোপণের
শর্ত আরোপ করল। রাসূল
(সা)
খুশী হয়ে চারা রোপণের ব্যবস্থা করলেন।
এবং
নিজ
হাতে খেজুর-চারা
রোপণ করে তাঁকে
মুক্ত করলেন। [মুস্তাদ্রাক
হাকিম ৬৫৪১, তাবারানি, আল্-মু’জামুল্ কাবীর ৬০৪০]
এই নশ্বর পৃথিবীতে
একজন বিশ্বাসীর মূল লক্ষ্য হলো মহান
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এবং বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
সম্ভব। কেননা গাছ লাগানো নবী (সা)-এর
অতি পছন্দনীয় একটি কাজ এবং তাঁর সুন্নত। সহজ করে
বললে, বৃক্ষরোপণও
এক ধরণের ইবাদত। অতএব বৃক্ষ রোপণ এবং বীজ বপনের পাশাপাশি সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ করাও আমাদের একান্ত কর্তব্য। এবং শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের কথা ভেবেও বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। একটি বর্ণনায় এসেছে, একদিন
বিখ্যাত সাহাবি আবু দার্দা (রা) একটি ফল গাছ লাগাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি তাঁর পাশ
দিয়ে যাচ্ছিলো। তাঁকে গাছ লাগাতে দেখে বলল, আপনি একজন সাহাবি। আপনি গাছ লাগাচ্ছেন!
আবু দার্দা (রা) উত্তরে বললেন— আমি রাসুল (সা)-কে বলতে শুনেছি, এই গাছের যে ফলমূল
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল খাবে সবই রোপণকারীর জন্য সাদকা রূপে গণ্য হবে। [মুস্নাদ
আহ্মাদ ২৭৩৭৯] অন্য বর্ণনায়, “আপনি তো বৃদ্ধ। মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আপনি এখন গাছ
লাগাছেন! এই গাছের ফল হতে তো অনেক বছর লেগে যাবে। আবু দার্দা (রা) উত্তর দিলেন, তাতে
কী! এর ফল অন্য মানুষ খাবে। আর আমি তার সুফল পাবো।” [শার্হুস্ সুন্নাহ্, বাগাবি
১৬৫২]
অন্য এক হাদিসে চাষাবাদ
ও বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করে মহানবী (সা) আদেশ করেছেন, “কিয়ামত
এসে গেছে, এমন অবস্থায় তোমাদের কারো হাতে যদি ছোট একটি খেজুর-চারা
থাকে,
তাহলে সে যেন চারাটি রোপণ করে দেয়।” [মুস্নাদ আহ্মাদ
১২৯০২, আল্-আদাবুল্ মুফ্রাদ
৪৭৯, মুস্নাদ বায্যার ৭৪০৮]
মানুষের কল্যাণেই যেহেতু অধিক সবুজ ভূমির প্রয়োজন। তাই নবী (সা) সবুজায়নের
নতুন পথও উদ্ভাবন করেছেন। অনাবাদী জমিগুলো যেন আবাদ হয়, সবুজ ভূমি বৃদ্ধি পায়,
মানুষকে উৎসাহিত করতে ঘোষণা করেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো পতিত ও পরিত্যক্ত ভূমি আবাদ
করবে সেই ব্যক্তিই ঐ জমির মালিক হবে।” [বুখারি ২৩৩৫]
একটি গাছের মূল্য— গাছের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার কথা মাথায় রেখে তিনি (সা) আদেশ করেছেন, আমরা
যেন বিনা-প্রয়োজনে গাছ না কাটি। একদিকে এটা যেমন অকৃতজ্ঞতা। অন্যদিকে নিজের হাতে
নিজের ধ্বংসকে অনিবার্য করে তোলা। কারণ, একটি গাছ
বাতাস থেকে ৬০
পাউন্ডেরও বেশি ক্ষতিকারক
গ্যাস শোষণ করে
এবং
১০টি শীততাপ নিয়ন্ত্রণ-যন্ত্রের
সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ
করে।
একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ
বছরে যে পরিমাণ
অক্সিজেন সরবরাহ করে
তা
কমপক্ষে ১০ জন
পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক
অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
টি
এম
দাস
১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক
একটি গাছের অবদান
আর্থিক মূল্যে বিবেচনা
করে
দেখান যে ৫০
বছর
বয়সী একটি গাছের
আর্থিক মূল্য প্রায়
এক
লাখ
৮৮
হাজার মার্কিন ডলার।
৫০
বছর
বয়সী একটি গাছ
বছরে প্রায় ২১
লাখ
টাকার অক্সিজেন সরবরাহ
করে।
বছরে প্রাণিসম্পদের জন্য
প্রোটিন জোগায় এক
লাখ
৪০
হাজার টাকার। [ইন্ডিয়ান
বায়োলজিস্ট, ভলিয়ম-১১,
সংখ্যা-১-২, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৯ (১৯৭৯)] তাই একটি
দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য
রক্ষার জন্য সে
দেশের মোট আয়তনের
২৫
ভাগের মতো বনাঞ্চল
থাকা জরুরি। তা
না
হলে
প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন
হতে
বাধ্য।
ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী
মানুষের জন্যই প্রকৃতি, পরিবেশ ও পৃথিবীর এই বিশাল আয়োজন। নির্মল বায়ু সুপেয় জলসহ গাছপালা,
নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-সমুদ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপকরণগুলো মানুষসহ সকল প্রাণীর
জন্য আবশ্যিক। অথচ মানুষই বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগরায়নের আড়ালে এই প্রকৃতিকে ধ্বংস
করছে। কল-কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া একদিকে যেমন বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে কার্বন
ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। অন্যদিকে কল-কারখানার নির্গত
শিল্পবর্জ্য পানিতে মিশে পানিকে করছে দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মৎস্য
প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আর তাই আল্-কুর্আন স্পষ্ট করে দিয়েছে, “জলে ও স্থলে বিপর্যয় ঘটে মানুষের কৃতকর্মের ফলে” [সূরা
আর্-রূম ৪১]।
যেহেতু
গাছ
প্রকৃতির অন্যতম উপকরণ।
ভূমি, জল ও
পরিবেশগত বৈচিত্র্যের অন্যতম
কারিগর। গাছ ছাড়া
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা
করা
অসম্ভব। এবং আমাদের
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান,
চিকিৎসা, নীতিকথা, বাণিজ্য,
দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি
সব
কিছুই গাছকে ঘিরে
ও
গাছকে নিয়ে। তাই
একটি গাছ নিহত
হলে
মানুষসহ সব প্রাণসত্তার
জন্যই তা ঝুঁকি
ও
উত্কণ্ঠার কারণ হয়ে
দাঁড়ায়। সুপেয় পানি
ও
নির্মল বায়ুর ঘাটতি
দেখা দেয়। দূষণ
বৃদ্ধি পায়। ধীরে
ধীরে প্রকৃতি তার
ভারসাম্য হারায়। এবং
ধ্বংস অনিবার্য হয়ে
ওঠে
পরিবেশ ও পৃথিবীর।
তাই, ইদানীং সমগ্র
বিশ্বে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে ও তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি
নেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হল বৃক্ষরোপণ। ইসলামও এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে
বহু কালজয়ী নির্দেশনা দিয়েছে। প্রাণী জগতের বসবাসের জন্য অনুকূল পৃথিবী গড়ার আহ্বান
জানিয়েছে। শুধু বৃক্ষরোপণ নয় বরং তা রক্ষাণাবেক্ষন বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করেছে। অতএব
মানুষ রূপে, মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের ঈমানি দায়িত্ব হল, আমরা যেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে উদ্যোগী হই।
পরিবেশের প্রকৃত বন্ধু গাছকে নির্বিচারে না-কেটে বরং বৃক্ষরোপণের শুভ উদ্যোগ গ্রহণ
করি। বিশ্বকবির ভাষায়, “আমরা যেমন স্নান করি এবং শুভ্র বস্ত্র পরিধান
করি, তেমনি বাড়ির চারিদিকে যত্নপূর্বক একখানি বাগান করিয়া রাখা ভদ্র প্রথার একটি অবশ্যকর্তব্য
অঙ্গ হওয়া উচিত।” [বাগান, রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ৩০ (বিশ্বভারতী, ১৪০৪)]
[পূবের কলম, ২২শে নভেম্বর, ২০১৯-এর দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্রে "বৃক্ষরোপণে উৎসাহ দিয়েছেন নবী মুহাম্মদ সা" শিরোনামে প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment