হজ্জ ও উম্রার রুক্নসমূহ
শায়েখ আব্দুল মুহ্সিন বিন হাম্দ
অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
হজ্জ ও উমরার রুক্ন হল ওই সব আমল ও কাজ, যেগুলো হজ্জ ও উমরায় সম্পাদন করা
অপরিহার্য। সেসবের পরিবর্তে অন্য কোনো কাজ
সম্পাদন করলে তা যথেষ্ট হবে না। অর্থাৎ অন্য কোনো আমল সেগুলির
স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে না।
উম্রার রুক্ন ৩টি। (১) ইহরাম বাঁধা, (২) ত়াওয়াফ করা (৩) এবং সা‘য়ি করা। আর এই রুকনগুলি হজ্জেরও রুকন। তবে হজ্জের ক্ষেত্রে আরেকটি (৪র্থ) রুকন হল, আরাফার ময়দানে
অবস্থান করা।
(১) ইহরাম— হজ্জ বা উম্রা শুরুর নিয়েত ও সংকল্প করা। মনে মনে নিয়েত না করলে ইহরাম
সম্পন্ন হবে না। কারণ রাসূল (সা) বলেছেন, “প্রত্যেকটি কাজ নিয়েতের উপর নির্ভরশীল। এবং প্রত্যেকেই তার
নিয়েত অনুযায়ী
প্রতিফল পাবে।”[1] [বুখারী হা/১, মুসলিম হা/৪৯২৭, উমার ইব্নুল খাত্ত্বাব
(রা) থেকে বর্ণিত]। ইব্নুল্ মুন্যির (রাহ) বলেছেন, “সবাই এ বিষয়ে একমত যে, কেউ হজ্জের তালবিয়া পড়তে গিয়ে ভুল করে উমরার তালবিয়া পড়ে ফেলে অথবা উমরার তালবিয়া পড়তে গিয়ে
ভুল করে হজ্জের তালবিয়া পড়ে ফেলে, সেক্ষেত্রে তার অন্তরের সংকল্প অর্থাৎ নিয়েতকেই ভিত্তি করা হবে; মৌখিক উচ্চারণকে নয়।” [ইজমা/৫৫]
(২) তাওয়াফ— এটি দ্বিতীয় রুকন। অর্থ, কা’বা ঘরের প্রদক্ষিণ ও পরিক্রমা করা। হজ্জের
ক্ষেত্রে ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্ রুক্ন। যেটি আরাফা এবং মুযদালিফা থেকে ফিরে এসে করা হয়। মহান আল্লাহ
বলেছেন, “তারা যেন এই সুসংরক্ষিত
গৃহের ত়াওয়াফ করে।”[2] [সূরা আল্-হাজ্জ ২৯]। মা আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, আমরা নবী (সা)-এর সাথে হজ্জ
করলাম। মুযদালিফা থেকে
ফিরে কুরবানীর দিন সাফিইয়া (রা) ঋতুবর্তী হয়ে গেলেন। একজন পুরুষ তার
স্ত্রীর কাছ থেকে যা কামনা করে, রাসূল (সা)-ও সাফিইয়ার কাছ থেকে তা-ই কামনা করলেন। আমি বললাম, আল্লাহ্র রাসূল! উনি তো ঋতুবর্তী। রাসূল (সা) বললেন ‘এ কি, সে তো আমাদেরকে আটকে দিল?’ বলা হল, আল্লাহ্র রাসূল! সে কুরবানীর দিনে ঋতুস্রাব আসার আগেই ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্ সম্পন্ন করে ফেলেছে। শুনে রাসূল (সা) বললেন, এবার তাহলে তোমরা মক্কা
ত্যাগ করো।”[3] [বুখারী হা/১৭৩৩, মুসলিম হা/৩২২৩]।
রাসূল (সা)-এর উক্তি “সে তো আমাদেরকে আটকে দিল?” অর্থাৎ, সে পবিত্র হয়ে ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্ করা পর্যন্ত আমাদেরকে মক্কাতে আটকে দিল? ইব্নু ক়ুদামাহ্ (রাহ) বলেছেন, “ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্ হজ্জের একটি রুকন। এটি সম্পাদন না করলে হজ্জ পূর্ণ হবে না। এবং এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত
করেছে বা কোনো মতানৈক্য আছে বলে আমার জানা
নেই। কেননা মহান
আল্লাহ বলেনছে, “তারা যেন এই সুসংরক্ষিত গৃহের ত়াওয়াফ করে।”[4]
[সূরা আল্-হাজ্জ ২৯] ইব্নু আব্দিল বার্ (রাহ) বলেছেন, এটি হজ্জের ফরযসমূহের একটি। এবিষয়ে ওলামাদের মধ্যে কোনো
মতানৈক্য নেই।” [আল্-মুগ়্নী, ৫/৩১১]
উম্রার ক্ষেত্রে, মক্কায় পৌঁছে সর্বপ্রথম যে ত়াওয়াফ করা হয়, সেটিই হচ্ছে উম্রার রুকন। আল্লামা ইব্নু রুশ্দ এ মর্মে বলেছেন, “সবাই এ বিষয়ে একমত যে, ত়াওয়াফ ক়ুদূম (অর্থাৎ মক্কায় পৌঁছে সর্বপ্রথম যে ত়াওয়াফ করা হয়) ব্যতীত অন্য
কোনো ত়াওয়াফ উমরাকারীর উপর
অপরিহার্য নয়।” [বিদায়াতুল মুজ্তাহিদ ১/৩৪৪]। ইব্নু ক়ুদামাহ্ (রাহ) ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্
যে হজ্জের রুকন একথা প্রমাণ করতে গিয়ে বলেছেন, “আর হজ্জ যেহেতু দুই ইবাদত (হজ্জ এবং উমরা)-এর মধ্যে একটি, সেহেতু উমরার মত সেখানেও ত়াওয়াফ একটি রুক্ন।” [আল্-মুগ়্নী, ৫/৩১২]
উল্লেখ্য যে, উম্রা-এর আভিধানিক অর্থ হল ভ্রমণ ও পরিদর্শন করা। শরিয়তের পরিভাষায় উম্রা হল কা‘বা ঘরের ত়াওয়াফ অর্থাৎ প্রদক্ষিণ ও পরিক্রমা করার উদ্দেশ্যে এবং স়াফা-মারওয়ায় সা‘য়ি করার উদ্দেশ্যে
কা‘বা ঘরের ভ্রমণ ও পরিদর্শন করা। রাসূল (সা) উম্রাতুল্ ক়াযা ও জি‘রানাহ্-এর উম্রাতে কা‘বা ঘরের ত়াওয়াফ করেছেন এবং স়াফা-মারওয়ায় সা‘য়ি করেছেন। আম্র ইব্নু দীনার বর্ণনা করেছেন, “আমরা ইব্নু উমার (রা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, যে ব্যক্তি উম্রাতে কা‘বা ঘরের ত়াওয়াফ করেছে, কিন্তু স়াফা-মারওয়ায় সা‘য়ি করেনি, সে কি স্ত্রী সহবাস করতে পারে?” উত্তরে তিনি বললেন, “রাসূল (সা) মক্কায় আগমন করে কা‘বার ত়াওয়াফ (অর্থাৎ সাত বার পরিক্রমা) করেছেন, মাক়ামু ইব্রাহীম-এর পেছনে দু’ রাকা‘আত সালাত আদায় করেছেন
এবং স়াফা-মারওয়ায় সা‘য়ি করেছেন (অর্থাৎ সাত বার
মন্থর গতিতে দৌড়েছেন)। এবং রাসূল (সা)-এর (কৃতকর্মসমূহের) মধ্যেই তোমাদের জন্য উত্তম নমুনা ও আদর্শ রয়েছে।”[5] [বুখারী হা/১৭৯৩, মুসলিম হা/২৯৯৯]
(৩) সা‘য়ি করা— উম্রার ক্ষেত্রে
সা‘য়ি করতে হবে ত়াওয়াফের পরে। যেমনটি রাসূল (সা)-এর উম্রাতুল্ ক়াযা ও জি‘রানাহ্-এর উম্রাতে এবং ইব্নু উমার (রা)-এর হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। তবে তামাত্তু’ হজ্জ-পালনকারীকে ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্-এর পরে সা‘য়ি করতে হবে। এবং ক়িরান ও ইফ্রাদ হজ্জ আদায়কারী ত়াওয়াফ ক়ুদূম অথবা ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্ পরে সা‘য়ি করবে। যদি ত়াওয়াফ ক়ুদূম-এর পরে সা‘য়ি না করে থাকে, তবে তাকে ত়াওয়াফ ইফাদ়াহ্-এর পরে অবশ্যই সা‘য়ি করতে হবে। মহান আল্লাহ
বলেছেন, “নিঃসন্দেহে স়াফা ও মারওয়া আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যারা কা‘বা ঘরের হজ্জ বা উমরা পালন করে, তাদের জন্য এ দু’টি স্থান (স়াফা ও মারওয়া) প্রদক্ষিণ করাতে কোনো দোষ নেই।”[6] [সূরা আল্-বাক়ারাহ্ ১৫৮]। রাসূল (সা) বলেছেন, “হে মানবমণ্ডলী! তোমরা সা‘য়ি করো। কেননা সা‘য়ি তোমাদের উপর
ফরয করা হয়েছে।”[7] [দারাক়ুত়নী, ২/২৫৫][8] মা আয়েশা (রা) বলেছেন, “স়াফা-মারওয়ায় সা‘য়ি না করা পর্যন্ত আল্লাহ কারো হজ্জ বা উম্রা কোনোটাই পূর্ণ করবেন
না।”[9] [বুখারী হা/১৭৯০, মুসলিম হা/৩০৮০]। এই আসারটির শব্দগুলো ইব্নু জারীর (রাহ) সূরা বাক়ারাহ্র ১৫৮ নং
আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছেন, আয়েশা (রা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি স়াফা-মারওয়ায় সা‘য়ি করল না, সে মূলতঃ হজ্জই করল না। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, “নিঃসন্দেহে স়াফা ও মারওয়া আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের অন্যতম।”[10]
[সূরা আল্-বাক়ারাহ্ ১৫৮] ইব্নু জারীর (রাহ)-এর এই বর্ণনার সূত্র বা সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত সাপেক্ষ।
সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ তিনটি অর্থাৎ ইহরাম বাঁধা, ত়াওয়াফ করা এবং সা‘য়ি করা হজ্জ ও উম্রার
রুক্ন। সা‘য়ির ক্ষেত্রে মতানৈক্য থাকলেও অধিকাংশ ওলামা ও বিদ্বানদের মতানুসারে এটাও রুক্ন।
(৪) আরাফায় অবস্থান করা— হজ্জের চতুর্থ রুক্ন হল আরাফায় অবস্থান
করা (এটা শুধুই হজ্জের; উম্রার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়)। মহান আল্লাহ
বলেছেন, “অতঃপর যখন তোমরা আরাফা
থেকে ফিরে আসবে।”[11] [সূরা আল্-বাক্বারাহ্ ১৯৮]। আর আরাফায়
অবস্থান করার পরেই তো সেখান
থেকে ফিরে আসার ব্যাপারটা আসবে। আরাফায় অবস্থান করা হজ্জের এমন একটি রুকন যে, সেটা ছুটে গেলে হজ্জই হবে না। কেননা আব্দুর রহমান বিন ইয়া‘মুর (রা) বর্ণনা
করেছেন, “আমি রাসূল (সা)-কে আরাফায় অবস্থান করতে দেখেছি। তিনি সেখানে অবস্থান করছেন এমন সময় নাজ্দের কিছু লোক তাঁর কাছে এসে বলল, আল্লাহ্র রাসূল! হজ্জ কীভাবে করবো? নবী (সা) বললেন, “আরাফায় অবস্থান করাই হজ্জ। অতএব যে
ব্যক্তি মুয্দালিফার রাতে
ফজরের পূর্বে এখানে উপস্থিত হল তার হজ্জ পূর্ণ
হয়ে গেল।”[12] [সুনান আরবা‘আহ্, হাদিসের শব্দগুলো ইব্নু মাজাহ্র, হা/৩০১৫][13] ইবনুল মুন্যির (রাহ) মন্তব্য করেছেন, “সবাই এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেছেন যে, আরাফায় অবস্থান
করা ফরয। কেউ যদি আরাফায় অবস্থান করতে না পারে বা ছুটে যায় তার হজ্জই হবে না।” [আল্-ইজ্মা/৬৪]
«إِنَّمَا
الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى»
﴿ وَلۡيَطَّوَّفُواْ
بِٱلۡبَيۡتِ ٱلۡعَتِيقِ ﴾
حججنا مع النبي صلى الله عليه وسلم فأفضنا يوم النحر،
فحاضت صفية، فأراد النبي صلى الله عليه وسلم منها ما يريد الرجل من أهله، فقلت: يا
رسول الله! إنها حائض، قال: حابستنا هي؟ قالوا: يا رسول الله! أفاضت يوم النحر،
قال: اخرجوا
﴿ وَلۡيَطَّوَّفُواْ
بِٱلۡبَيۡتِ ٱلۡعَتِيقِ ﴾
سألنا ابن عمر رضي الله عنهما عن
رجل طاف بالبيت في عمرة ولم يطف بين الصفا والمروة: أيأتي امرأته؟ فقال: قدم النبي
صلى الله عليه وسلم فطاف بالبيت سبعا، وصلّى خلف المقام ركعتين، وطاف بين الصفا
والمروة سبعا، وقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة
﴿ إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ
حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ ﴾
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ اسْعَوْا
فَإِنَّ السَّعْيَ قَدْ كُتِبَ عَلَيْكُمْ»
[8] দারাক়ুত়নীর সূত্রে বায়হাক়ীও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ৫/৯৭। মা‘রূফ ইব্নু মুশকান ব্যতীত
দারাক়ুত়নীর বর্ণনাকারীগণ
সবাই স়িক়াহ্ অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য। মারূফ সম্পর্কে ইব্নু হাজার (রাহ) তাঁর প্রসিদ্ধ ‘তাক়রীবুত্ তাহ্যীব’-এ বলেছেন, তিনি ‘স়ুদূক্ব’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত। অতএব, হাদিসটির সনদ ‘হাসান’। ইমাম নববী (রাহ) এটিকে
‘হাসান’ বলেছেন (আল্-মাজ্মূ ৮/৮২)। এবং মিয্যী ও
ইবনু আব্দিল হাদী ‘সাহীহ’ বলেছেন। শায়খ আলবানী (রাহ) প্রণীত ‘ইর্ওয়াউল্ গ়ালীল’-এর ১০৭২ নং
হাদিসের অধীনে হাদিসটির আরো
কয়েকটি সনদ বা বর্ণনাসূত্র
উল্লেখিত হয়েছে।
«مَا أَتَمَّ اللَّهُ حَجَّ
امْرِئٍ وَلَا عُمْرَتَهُ لَمْ يَطُفْ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ»
لعمري! ما حجّ منْ لم يسع بين الصفا والمروة؛ لأن الله
تبارك وتعالى يقول: ﴿ إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ ﴾
[البقرة: ١٥٨]
﴿فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ ﴾
« شهدت رسول الله صلى الله عليه
وسلم وهو واقف بعرفة وأتاه ناس من أهل نجد فقالوا: يا رسول الله! كيف الحجّ؟ قال: الْحَجُّ
عَرَفَةُ، فَمَنْ جَاءَ قَبْلَ صَلاَةِ الْفَجْرِ لَيْلَةَ جَمْعٍ، فَقَدْ تَمَّ
حَجُّهُ »
[13] হাদিসটি সাহিহ। বুকাইর ইব্নু ‘আত়া নামক
বর্ণনাকারী ব্যতীত হাদিসটির সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত সাপেক্ষ। বুকাইর হচ্ছেন স়িক়াহ্ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।
No comments:
Post a Comment