Monday 18 November 2019

বদিউর রহমানঃ চেনা পথ অচেনা পথিক



চেনা পথ অচেনা পথিক
বদিউর রহমান
২০১৭-এর শ্যামাপূজা ছিল ১৯শে অক্টোবর বৃহস্পতি বার। পূজো উপলক্ষে আতশবাজির জন্য কোলকাতা শহরের বাতাসে দূষণ বৃদ্ধি সর্বজন বিদিত। ইদানীং আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। তাই, দূষণ থেকে বাঁচতে পাণ্ডুয়ার বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার স্ত্রীও সঙ্গে থাকবে জানতাম। মনঃস্থির করলাম, গাড়ি করে যাব। কিন্তু ওঁর কিছু বিশেষ কাজ থাকার জন্য যেতে চাইল না। ঠিক করলাম, একাই যাব। আর গাড়িতেই যাব। আমার স্ত্রী কয়েকবার নিষেধ করল, একা একা গাড়ি নিয়ে যেওনা। তাছাড়া গাড়িতে যাওয়া আসার খরচ ট্রেনের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। আমারও একরকম জেদ হল, হোক বেশি খরচ; এবার একা হলেও গাড়িতেই যাব। ওখানে পরিচিতদের কাছে সম্ভ্রম আদায়ে সহায়ক হবে।

বুধবার, ১৮ই অক্টোবর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে ল্যাপটপ ব্যবহার করতে চেষ্টা করছি। একটা প্রবন্ধ কিছুটা টাইপ করেছি। ঠিক করলাম, ল্যাপটপটা সঙ্গে নিয়ে যাব। নিশ্চিন্তে কাজটা করা যাবে। ল্যাপটপ ও সঙ্গে জামাকাপড় ইত্যাদি-র ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে যাওয়ার থেকে গাড়িতে যাওয়াই শ্রেয়। ১৯ তারিখ সকালে আমার স্ত্রী বলল, তাঁকে তাঁর বাপের বাড়ি ড্রপ করে পাণ্ডুয়া যেতে। ইই ব্লকে পেট্রোল নিলাম না। স্ত্রীকে ড্রপ করে তিন মূর্তি পাম্প থেকে পেট্রোল নিলাম। বিভিন্ন রাস্তা এক মুখী হওয়ায় জিলিপির প্যাঁচের মতো ঘুরপাক খেয়ে এপিজে ফ্লাই ওভার ধরে পিজির পাশ দিয়ে বিদ্যাসাগর সেতু পার করে কোণা এক্সপ্রেস হয়ে ধরলাম দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে। 

সল্টলেক থেকে বের হতেও বেশ দেরী হয়েছিল। প্রায় দুপুর সাড়ে বারটায় পাণ্ডুয়া রওয়ানা দিলাম। ইচ্ছা ছিল আরও আগে বের হওয়ার। যাতে একটা-দেড়টার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়। বের হলাম সাড়ে বারটায়, অভুক্ত। মাঝে মধ্যে থামতে ইচ্ছে হচ্ছিল। একটু চা খাওয়ার জন্য। সুন্দর মসৃণ রাস্তায়, দুরন্ত বেগে গাড়ি চালাতেও ভালো লাগছিল। কোথাও না থামার, সেটাও একটা কারণ। চুঁচুড়ার সাইড রোডের পর ভাস্তাড়ার সাইড রোডে নেমে ডান হাতে গুড়াপের রাস্তা ধরলাম। যাওয়া আসার পথে বর্তমানে যে দোকানটায় চা খেয়ে থাকি, সেটা এবং তার আশেপাশের অন্যান্য দোকান পাঠও বন্ধ। হয়তো দুপুরের খাবার খেতে যে যার বাড়ি চলে গেছে; সেটাই স্বাভাবিক। 

এগিয়ে চললাম। একটি ঝুপড়ীর মতো দোকানে। দেখলাম, পরস্পর বিস্কুটের বয়াম সাজানো। গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে দেখলাম, ঐ দুটো-আড়াইটার সময়ও উনানের উপর চায়ের কেটলি বসানো। থামলাম। রাস্তাটা পূর্ব-পশ্চিমে। আমি পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে যাব। চায়ের দোকানটা রাস্তার দক্ষিণ দিকে। দোকানের লাগোয়া কাঁচা রাস্তা চলে গেছে একটা গ্রামের দিকে। অনতি দূরের বাড়িগুলোর চালচিত্র বলে দিচ্ছিল গ্রামটা আদিবাসীদের। মাটির দেওয়ালগুলো কী সুন্দর লেপা, অদ্ভুত সুন্দর লতাপাতা আঁকা! চায়ের দোকানে খদ্দেরদের বসার জন্য সাত-আট ফুট লম্বা বাঁশের চালি করা বেঞ্চ। ঐ রকম আর একটা বেঞ্চ দোকানের পশ্চিম প্রান্তেও। 

রাস্তা পার করে চায়ের দোকানের দিকে এক-পা দুপা করে এগুতে থাকি । প্রায় দুঘণ্টা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে পা গুলো যেন ধরে গেছে। হাঁটার গতিটা ছিল মন্থর। ঐ দোকানের বেঞ্চে দুজন বসে ছিলেন । একজন আদল গায়ে । রোদে-পোড়া কালচে তামাটে গায়ের রং। পাঁজরের হাড় গুলো গুণে নেওয়া যায় । গায়ের হাত কাঁটা গেঞ্জিটা মনে হল দুর্গা পূজোর সময় গায়ে উঠেছে । ধোয়ার বালায় নেই । পূজোর মরশুম বলে কি জানি না, তিনি সুরা পান করে ঐ বেঞ্চে বেশ কসরত করে বসে ছিলেন । তা না হলে জামাপ্যান্টুলে আর একজন আদিবাসি যুবক মাটিতে অবশায়িত হয়ে মোতাত করবে কেন । অবশ্য ঐ বেঞ্চে একজন গ্রাম্য ভদ্রলোক সাদা টেরিকোটের পুরাতন পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরে বসে ছিলেন । তার সামনে দিয়ে গ্রামেরই এক স্বামী ও স্ত্রী তাদের মেয়েকে নিয়ে ছোট ক্যানালটার দিকে যাচ্ছিল। দোকানে-বসা ভদ্রলোক তাদেরকে অ-বেলায় স্নানে যাওয়া নিয়ে একটু মস্করা করলে তার উত্তর দিল মহিলাটি; আর স্বামীটা মিটি মিটি হাসতে থাকল । তারা এগোতে থাকলে ঐ ভদ্রলোক আরও কথা বলা ও সোনার আগ্রহে উচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, বউ স্নানে যাচ্ছ তা হাতে খড়ের নুটি কেন? মেয়ের বিয়ের স্নানে ঘা ঘসবে নাকি? যুবতী মায়ের উত্তর, তা কর্তা বিয়ে যখন দেবো, তোমাকে নেমন্তন্ন না কর দেবো নাকি? ঠিক জানতে পারবে। বিয়ের কথা শুনে ফ্রোক পরা মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত ধরে চলতে লাগলো। আমার মনে হল, মেয়ে বাবার আশ্রয় ও স্নেহে আরও কিছুকাল থাকতে চায়। চোদ্দ-পনের বছরের মেয়ের বিয়ের কথায় আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। উত্তরটা কানে আসলে একটু আশ্বস্ত হই। কোলকাতার অতি স্বচ্ছল ফ্যাশন দুরস্তরা স্বল্প বস্ত্রে যতটা না দৃষ্টি-নন্দন তার থেকে অনেক স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল ঐ বউটার উঁচু করে পরা সাড়িতে। হাতে পায়ে কাদার চিহ্ন নিয়েও সদ্দ মাঠের কাজ সেরে যৌবনে পা দেওয়া মেয়েকে নিয়ে যাওয়া দেখে ডাক্তার সাহেবের ডাক্তার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। কোলকাতার ওরা সব পোলট্রির মুরগি। হয়তো তা-ই। এরা মাঠে ঘাটে পরিশ্রম করে। রোদ বৃষ্টিতে তামাটে রং-এর ওপর ঘামের বিন্দুগুলো কি সুন্দর চকচক করে। যার রসবোধ আছে, জানি অপ্রয়োজনেও তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে। 

আমি নিজে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসি। খুব বেশি সিভিলাইজড্‌ মানুষের সঙ্গে সল্টলেকে জেঁচে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় অবজ্ঞার স্বীকার হয়েছি; কিন্তু অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। শুধুমাত্র কথা বলার জন্যই ভদ্রলোকের কথার খেই ধরে শুধালাম, অত ছোট মেয়ের কখনো বিয়ে হয় না কি? 

আমার কথা শুনে রাস্তার দিক থেকে সটান ঘুরে আমাকে বললেন, দেখে মনে হচ্ছে কোনো শহরে বসবাস করেন? আমাদের গ্রামের ব্যাপারস্যাপার আপনার হয়তো জানা নেই। তাছাড়া ওরা আমার পরিচিত। তাই একটু রসিকতা করছিলাম আর কি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘একটু চা চলবে?’ অস্বীকার করলেন। বললেন, ‘আমি দিনে দুবার চা খাই। একবার সকালে যখন আযান দেয়। আরেকবার সন্ধ্যায়। সবে মাত্র ভাত খেয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাড়িতে ভালো লাগে না। কতক্ষণ আর দুমানুষে ঘরে থাকা যায়! পাঁচটা ছেলে; সব আলাদা থাকে। দুটো মেয়ে; বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। তারা যে যার সংসার করে। তাই বাড়িতে বেশি থাকি না। সব সময় খিটির খিটির ভালো লাগে না । 

কি আর করি? কংকালসার লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম- একটু চা চলবে নাকি?’ উত্তর এলো, ‘তা খাওয়া যায় বটে ।চা-ওয়ালার বয়সটা কম। বললাম ভাই, ‘দুটো চা করো। বেশ ভালো করে। মন দিয়ে করো কিন্তু ।উত্তর দিল, ‘বিভীষণের চা কেমন- এই এলাকার লোকেরা জানে। খেয়ে দেখেন। তারপর বলবেন ।পাঞ্জাবী পরিহিত ভদ্র লোক সংযোজন করলেন, ‘আর একটু বেলা বাড়লে দেখতে পাবেন। পাশাপাশি গ্রাম থেকে কত ছেলে ছোকরা সাইকেল, মোটর সাইকেল চড়ে এখানে চা খেতে আসে। অমন এক কাপ চায়ের জন্য আপনাকে আধ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হতে পারে । 

বললাম, তাই না কি! এত বাইক! উনি বললেন, ‘আর বলবেন না, আজকালকার ছেলেদের ফুটানি কত! বাইক ছাড়া চলে না। আমারও একটা আছে। তবে খুব একটা চড়ি না। আর চড়ব কি! বউকে যদি বলি মহানাথ বাজার যাচ্ছো,বাইকের পেছনে বসো নিয়ে যাচ্ছি। যাবে না।সেই মুহূর্তে রাস্তা দিয়ে একটা বাস গেল। আঙুল তুলে দেখাল, ‘ঐতে যাবে। বলি কি পর পুরুষের গায়ে ঠেস দিয়ে যাওয়ার চেয়ে আমার বাইকে চলো। তা শুনবে না। তাই বাইকটা চালাই না। এই তো দেখুন না, সাইকেলে করে কেমন চলে এলাম। বাইক কিনলেই তো হবে না, পেট্রোল ছাড়া চলবে না। আর পেট্রোলের যা দাম! তা বলুন না, এই যে আপনার গাড়ি, তা দাম কত হবে? লাখ দুয়েক?’ বললাম, ‘অত না। এক লাখ মতো।উনি বললেন, ‘আমিও ওরকম একটা গাড়ি কালই কিনতে পারি। কিন্তু কিনলেই তো হবে না, চালাতে হলে খরচ আছে। বলো বিভীষণ।চা-ওয়ালা বলল, ‘যা বলেছ নুরুল চাচা।চা-ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নামটা?’ সে বলল, ‘ঐ আপনারা বলেন না, ঘরের শত্রু বিভীষণ। বিভীষণ আমার নাম । 

ওদিক থেকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা কোথায় যাওয়া হবে?’ বললাম, ‘পাণ্ডুয়া। উত্তর এলো, ‘পাণ্ডুয়ার দীঘির পাড় চেনেন? আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। বললাম, ‘তা আমার সঙ্গে চলুন। মেয়ের সঙ্গে দেখা করে আসবেন।বললেন, ‘বললেই কি আর যাওয়া হয়; সে অনেক বাকি আছে।ভদ্রতার খাতিরে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তা আপনার বাড়ি কোথা?’ বললেন, ‘নারকেল শাঁড়া। পুলকিত হয়ে বললাম, ‘আরে আমাদের সামনের বাড়িটা তো নারকেল শাঁড়ার লোকের বাড়ি। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি নাম বলুন তো?’ বললাম, ‘আইয়ুব রহমান সাহেবওহ রউফ মাস্টারের ভাই তো? তা ঠিকই বলেছেন। সে ওখানে বাড়ি করে বসবাস করে। পাণ্ডুয়ায় থাকাকালীন ঐ বাড়িতে গিয়েছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তার মানে?’ বললেন, ‘বছর তিনেক দারুল উলুম মাদ্‌রাসায় পড়েছি, তখনকার কথা বলছি। অবাক হয়ে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওখানে কবে পড়তেন?’ উত্তর এলো, ‘তা মনে নেই। তবে লম্বা চওড়া দুজন মৌলানা পড়াতেন; কি যেন চিস্তি!সংযোজন করলাম, ‘আব্দুল হাই চিস্তি আর নেমাতুল্লাহ সাহেব। বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোন্ পর্যন্ত পড়েছেন? কী কী বই পড়েছেন?’ উত্তর এলো, ‘সে-সব কিছুই মনে নেই। তবে একটা প্রতিবন্ধি ছেলে ছিল আমার ক্লাসে। তার হাত পা গুলো ভাঁজ হতো না। চামুচে করে খেত। আমি সংযোজন করলাম, ‘দে পাড়ার ফজলু।বললেন, ‘ঠিক। আপনি বলতে নামটা মনে পড়েছে।তারপর বললেন, ‘আর একটা ছেলে ছিল, তার নাম সেলিম। বললাম মগলামপুর পশ্চিম পাড়ায় তার বাড়ি। তাকে চিনি। আমি নিঃসন্দেহ যে উনি সেখানে পড়াশুনা করেছেন। সেই বিগত দিনের মাদ্‌রাসায় পড়ার প্রভাব এখনও বর্তমান কি না জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা বলছিলেন যে সকালে আজানের পর চা খান,- তা ফজরের নামাজ পড়ে নিয়ে, না তার আগে?’ উত্তর এলো, ‘আমি নামাজ পড়ি না। আমার সোজা সাপটা কথা। পড়ি না, তো পড়ি না। আজানটা শুনে চা খাই। তারপর এই রাস্তার ধারে চলে আসি। তর্ক না করে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ‘নুরুল ইসলাম। স্মৃতির অতল তলে ডুব দিয়েও কিছুতেই তাঁকে উদ্ধার করতে না পেরে বললাম, ‘আমাকে চিনতে পারছেন?’ অনেকক্ষণ আমাকে দেখে বললেন না, চিনতে পারলাম না। আমার নাম শুধালেন। বললাম। তাও ওঁর মনে পড়লো না। বললাম, ‘আচ্ছা আপনি যখন পাণ্ডুয়ায় পড়তেন কে সেক্রেটারি ছিলেন মনে আছে? বললেন, ‘না। আমার আব্বার নামটা বললাম। বললেন মনে করতে পারছি না। নিজের পরিচয়, পিতৃ পরিচয় কোনওটার প্রতি তাঁর বিন্দু মাত্র আগ্রহ দেখা দিল না। হঠাৎ মনে হল বৃথা আমার দীর্ঘ দিনের কৃচ্ছ সাধন। অপরিচিত এসেছিলাম; অপরিচিতই বিদায় নিলাম। 

[শব্দের মিছিল, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৮, আত্মকথা বিভাগে প্রকাশিত] 

No comments:

Post a Comment