Thursday 7 November 2019

বদিউর রহমানঃ সোনার দাম উর্দ্ধমুখী, আমার অবস্থা করুণ!


সোনার দাম উর্দ্ধমুখী, আমার অবস্থা করুণ!
বদিউর রহমান

দৈনিক কাগজে দৈনন্দিন খবরাখবর থাকে। থাকে সুন্দর সম্পাদকীয় ও ঐ পৃষ্ঠাতেই সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী বিভিন্ন বিষয়ে অতীব প্রয়োজনীয় লেখা। সপ্তাহান্তে থাকে পুস্তক সমালোচনা, ধারাবাহিক উপন্যাস, ছোটগল্প যা আমাকে ভীষণ ভাবে উদ্দীপ্ত করে। পাতাভর্তি থাকে বিভিন্ন রকমের বিজ্ঞাপন— তা শিক্ষাদীক্ষার হোক, প্রসাধনী রূপচর্চার সামগ্রীর হোক বা অন্য রকমের আকর্ষণীয় দ্রব্যাদির। খেলার পাতাগুলো চোখ বোলাতে ভালো লাগে। দেখি নাদাল, সেরেনা, ফেডেরার, নেমার, মেসি, রোনাল্ডো অথবা বিরাট ও তার দলবলকে। মাঠের মধ্যেও দেখি কত নূতন রেকর্ড, কত উত্থানপতন। অনেকের কাছে আবহাওয়ার খবর বা পূর্বাভাসের বার্তাটা খুব প্রয়োজনীয়। ইদানিং পেট্রোল-ডিজেলের দামের ওঠাপড়াটাও দৈনিক কাগজে পাওয়া যায়। কিন্তু কাগজে সোনার দামের ওঠাপড়াটা অনেক মহিলাই মনযোগ সহকারে লক্ষ্য করেন। স্বর্ণকার বা স্বর্ণব্যবসায়ীরা অবশ্য ওই খবরটা ব্যবসায়িক কারণে লক্ষ্য করেন। সোনার দামের ওঠাপড়া যে আমার ঘুম কেড়ে নেবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।
সকালে বাজারফেরত চা-টা খাচ্ছিলাম। খাবার টেবিলের পিছনদিকে সোফায় বসে আনন্দবাজারে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ উনি আর্তনাদ করে উঠলেন, “শুনছ! সোনার দাম দু’হাজার টাকা বেড়ে গেল!” কথাগুলো শুনেও চুপ করে চা খাচ্ছিলাম। ঐ ব্যাপারটার জন্য কোনরকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক প্রয়াত ঁঅরুণকুমার বসুর কাছে শুনেছিলাম যে গোয়েঙ্কাদের একজন, সম্ভবত আর কে গোয়েঙ্কা, বলেছিলেন, “যে জিনিসটার আমার প্রয়োজন নেই সেটা যত কম টাকাতেই কেউ দিক না কেনতা আমি কিনে পয়সা নষ্ট করব না আবার যে জিনিসটার আমার প্রয়োজন তার দাম কেউ পাঁচগুণ বাড়িয়ে বললেও আমি তা কিনবমূল্যবান কথাটা আমার জীবনের চলার পথে বিশেষ সহায়ক অপ্রয়োজনে খরচ করার আমি পক্ষপাতি নই তাই সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় আমি নিস্পৃহ ওদিক থেকে আবার ক’টা কথা ভেসে এল—“দাম মনে হচ্ছে আরও বাড়বে আজকাল কী লিখছে? এইবেলা আমাকে দুটো বালা করে দাও ঘরে পরবএবার চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেলাম আবার ওই জাতীয় উক্তি—“কী, বালা গড়িয়ে দিচ্ছ তো? আজই ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তোল শনিবার পি সি চন্দ্র নিয়ে যাবেআমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না বললাম, “দুহাতে তো বালা পরেই আছ আবার বানাবার কী দরকার!” উত্তর এল—“এগুলো অনেক পুরোনো ডিজাইনের এগুলো নাহয় বদলে বাকিটা টাকা দিয়ে নিলেও হবেআমি আঁতকে উঠে বলি, “সে কী! কেন ওই বালাগুলো ভেঙে নতুন বালা নেবে! তা কখনো হয়! অনেকদিন থেকে ওই বালাগুলো তোমার হাতে দেখছি আর ওগুলো ভেঙে ফেলবে বা পালটে অন্য বালা কিনবে! তা হয় না ওগুলো পাল্টাবে না মাঝেমধ্যে রিঠার পানিতে পরিষ্কার করে পরউত্তর এল, “তা বেশ, তাহলে নতুন করে তৈরি করিয়ে দাওবিরক্ত হয়ে বললাম, “যে সব গয়না আছে সেগুলো তো ব্যাঙ্কের লকারেই পড়ে থাকে তা আবার নতুন করে কেনার কী অর্থ?” উত্তর এল, “, তাহলে দেবে না!!”
তারপর শুরু হল আমার কর্ণকুহরে নির্ঝরের বর্ষণ যুক্তি সহকারে প্রশ্ন আসতে থাকল, “তোমার ছোটভাই স্কুলে শিক্ষকতা করেও ঈদে তার স্ত্রীকেকল্যানথেকে বালা করে দিল তা দেখে তোমার লজ্জা করে না?” বললাম, “না, লজ্জা করে না জানই তো আমি একটু নির্লজ্জব্যস, আগুনে ঘৃতাহুতি হল শুরু হল, “শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারবে না তো বিয়ে করেছিলে কেন?” বিবাহিত জীবনে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হব কল্পনাও করিনি আমি নিরুত্তর পুনরায় শুরু হল আমার মুন্ডুপাত সঙ্গে চলল নিজেকে দাসীর সঙ্গে তুলনা, এমনকি,  নিজেকে ক্রীতদাসী প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ অপচেষ্টা আর চলল স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে তারাও অপেক্ষাকৃত ভাল আছে; মাস গেলে মাইনে পায় আর ও তো সেটাও পায় না সত্যি কথা বললাম, “দুমাস আগে দশহাজার দিয়েছিলাম আর কিছুদিন আগে চার হাজার দিতে গেলে তুমিই তো অবলীলাক্রমে তা নিতে অস্বীকার করলেবজ্রকঠিন কণ্ঠে শুনতে হল, “হাত নোংরা করার জন্য যৎসামান্য টাকা আমার চাই নাটাকাগুলো নিল না তাই তুলে রেখেছিলাম এখন দেখছি, ওই পরিমাণ টাকার থেকে হাতের বালার জন্য অনেক বেশি অঙ্কের খরচের ধাক্কায় পড়লাম উর্দুতে একটা কথা আছে, ‘গিরা আসমান সে লটকা খেজুর পে (আকাশ থেকে পড়লাম, তাও আবার খেজুর কাঁটায়)!!
জীবনে দু’জন মান্যবর মানুষকে দেখে একটা অভ্যাস রপ্ত করতে অনেকবার চেষ্টা করেছি। তা হল প্রয়োজন অনুসারে কালা হয়ে যাওয়া। তির্যক বাক্যবাণ অথবা শরনিক্ষেপ করে আমাকে জর্জরিত করার চেষ্টা অনেকটা ভোঁতা করতে সাহায্য করল সবকিছু শুনতে না পাওয়ার ভান।
মাদ্রাসা বোর্ডের কাজটা শেষ করার জন্য মনোনিবেশ করতে সচেষ্ট হলাম। সেটার পর এক অধ্যাপকের প্রবন্ধ ছাপার যোগ্যতানির্ণায়ক সার্টিফিকেট লিখতে আরম্ভ করলাম। আগ্নেয়গিরির প্রখর তাপের মাঝে বসে কিছু লেখা যে কত দুরূহ তা ভুক্তভোগীরা জানেন। রিংয়ের মধ্যে বিপক্ষকে মেরি কম যেভাবে কাবু করে আমার অবস্থাও তথৈবচ। মাথামুণ্ডু যা পারলাম লিখে স্নান-খাওয়াটা কোনক্রমে সেরে বুক ভরে মুক্ত বাতাস নিতে বের হলাম—বলতে পারেন বাঁচার জন্য রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালাম
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মাঝে প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা বলে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় গাড়ীর কাছে গিয়ে দেখি—গাড়ীর হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখেই ক্লাসে চলে গিয়েছিলাম ঝাঁ চকচকে বিল্ডিঙয়ের ছ’তলায়; লিফটে। এবারটা নিয়ে তিনবার ঐ ভুল করলাম। বুকটা ধড়াস করে উঠল আবার ব্যাটারীর মিস্ত্রিকে গচ্চা দিতে হবে মনে করে। একবার ভাণ্ডারীর লোক নিয়েছিল ছ’শ। পরের বার দেড়শ। কিন্তু সে বার ব্যাটারীর জন্যই দরজার রিমোট খারাপ হয়ে যায়। সেটা সারাতে লাগল ষোল’শো। আবার সেই লাইট জ্বালিয়ে রাখার ভুল!
লাইটটা বন্ধ করে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ভাগ্য প্রসন্ন। স্টার্ট হল। গাড়িতে বসে বাড়ির দিকে এগোতে থাকি। বাড়ির শ্বাসরোধ করা আবহাওয়াটা দূর হল কি না ভাবতে ভাবছিলামচিন্তাটা এত বেশী হচ্ছিল যে, অনেকবার পাশাপাশি গাড়ির গতি ও হাবভাব সম্যক ঠাহর করতে পারছিলাম না। ঐভাবেই বাড়ী পৌঁছাই। উনি টিভিতে ব্যস্ত ছিলেন। নিজে পানি ঢেলে খেলাম। এক কাপ চা যেভাবে টেবিলে রাখলেন তাতেই পরিষ্কার বুঝলাম পরিস্থিতিটা পাল্টায়নি। সেই গুমোটটা রাত পর্যন্ত কাটেনি। ভাবলাম দেখা যাক, সকালটা কেমন যায়। আশা করি তখন সব দুর্যোগ কেটে যাবে।
প্রায়ই তো শুনি নিফটিতে বিভিন্ন কারণে বাজারদর ওঠানামা করে। তার প্রতিফলন ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ও শেয়ার বাজারে দেখা যায়। কোন আন্তর্জাতিক কারণে শেয়ার বাজারে প্রভাব পড়ে। শেয়ার বাজারে কখনো বুল তো কখনো বিয়ার। সতর্ক ইনভেস্টররা তখন সোনা কেনার দিকে ঝোঁকেন। আবার সোনার চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দরও বাড়ে। আবার বুলিয়নের জন্য ডলার-পাউণ্ডের উপরও প্রভাব পড়ে যার জেরে পেট্রোপণ্যের উপর প্রভাব পড়তে বাধ্য যে কারণে আমাদের দেশের অর্থনীতির উপরও প্রভাব পড়ে তার পরোক্ষ প্রভাবে সব জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পায়, এমনকী সব্জিবাজারও তা থেকে রেহাই পায় না নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে শোওয়ার ঘরে যাওয়ার কথা ভাবলাম কেননা রাত বারোটা অনেক আগেই বেজে গেছে যেমনটা হয়েছে আমার তবুও স্মরি ধন্য আশা কুহকিনী আশা করি সকাল পর্যন্তবালাভূত দূরীভূত হবে ঘরে শান্তি বিরাজ করবে
উনি শয়নকক্ষে এসিতে গা এলিয়ে দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে মগ্ন আমি গুটি গুটি পায়ে গিয়ে  টিউবলাইট বন্ধ করে ছোট্ট করে শুয়ে পড়ি চিন্তা-দুশ্চিন্তায় চোখের পাতায় ঘুম আলিঙ্গন করল দেখি গা-ভর্তি গয়নায় সুসজ্জিত হয়ে নববধূর সাজে কে যেন দাঁড়িয়ে চকিতে হাতের দিকে চেয়ে দেখি নূতন বালাদ্বয় শোভাবর্ধন করে বলছেসোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলংকারধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে একগ্লাস জল খেয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু চিন্তাটা দূরীভূত করতে পারছি না কী জানি সকাল হলে আবার কী হয়!
রাতের পর দিন ও দিনের পর রাতের চক্রকে মানুষ কোনদিন ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়নি তাই যথা নিয়মে সকাল হল টা-সাড়ে ছটায় ওঠার চেষ্টা করলাম মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করল আরও একটু শুয়ে রইলাম বাড়িতে আমরা দুজন প্রাণী গতকাল রাত থেকেই খাবারদাবার দেওয়া ইত্যাদি সব কাজই নিঃশব্দে করে গেলেন নিজের খাবারটা আলাদা প্লেটে নিয়ে আমার সঙ্গে খাবার টেবিলে না বসে শোওয়ার ঘরে এসিতে চলে গেলেনঐসব কথাগুলো মনে আসতে শরীরটায় ঠিক জুত পাচ্ছিলাম না। এমন সময় সকালের চায়ের ঘ্রাণটা টের পেলাম চিনিটা চামচ দিয়ে নাড়ানোর আওয়াজটাও কানে এল বুঝলাম আমার চা-টাও তৈরি; কেননা ওনারটায় সুগার-ফ্রি পাউডার দেওয়া হয় তার জন্য চামচ দিয়ে খুব একটা নাড়তে হয়না চায়ের টানে বিছানা ত্যাগ করলাম সকালের চা-টা উপভোগ করলাম তার পরপরই সিগারেট ধরালাম সবে মেজাজটা একটু ফুরফুরে হয়েছে, উনি বললেন, “আমার হাতখরচের জন্য দাও দশহাজারসুবোধ বালকের মত তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিলাম দশ হাজার ভাবলাম ঘরের শান্তি বজায় রাখা প্রধান ও অন্যতম কর্তব্য অন্যদিকে হয়ত বড় খরচের ধাক্কা থেকেও বেঁচে যাব আশা করি কিন্তু কয়েকদিন পর আবার যদি বালা কিনে দেওয়ার বায়না তোলেন, তাহলে তো আমার অবস্থা অনেকটাআমও গেল ছালাও গেল!!’
আপনাদের আশীর্বাদে কদিনের মধ্যে ঘটলোও তাই আবার সেই পুরোনো রেকর্ড বেসুরে বাজতে লাগলআমার নূতন বালা চাইবুঝলাম ভবি ভুলবার নয় কপাল ঠুকে এক দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম পি সি চন্দ্র তাৎক্ষণিক এফেক্টটার কথা বাদই দিন কয়েকদিন গদগদ চিত্তে আমার কী সেবা! সত্যি বলতে কী, ষোলআনা পুষিয়ে গেল কী, বিশ্বাস হল না? নিজেরা পরীক্ষা করে দেখবেন, যখনই ওনারা বলবেন, ‘আমার সোনার হরিণ চাই’, বন-জঙ্গল উজিয়ে সেটা এনে দেবেন দেখবেন ওনারা কত খুশী আমার গ্যারান্টি রইল, অমন না হলে আমাকে হরিণ ফেরত দেবেন , দ্বিগুণ মূল্য পাবেন তা সোনার দাম যতই উর্দ্ধমুখী হোক না কেন

4 comments:

  1. অপরের রিয়েল লাইফ এক্সপেরিয়েন্স থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রকৃত জ্ঞানের পরিচয় হবে....

    ReplyDelete
  2. বাস্তব সত্য

    ReplyDelete
  3. স্যারের রসবোধ বারবার আমাকে মুগ্ধ করে। আরো লিখুন স্যার।

    ReplyDelete
  4. মাশাল্লাহ স্যার, খুবই মনগ্রাহী এবং অতি বাস্তব কথা তুলে ধরেছেন। যে সমস্ত বিষয়ে আমাদের চোখ পড়ে সারাক্ষণ কিন্তু কখনও কল্পনার দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারিনি । আপনার জন্য দুআ করি সৃষ্টিকর্তা যেন আপনার লেখনীশক্তি আরো বাড়িয়ে দেয়, আপনার আয়ু যেন দীর্ঘায়িত করে দেয়।

    ReplyDelete