Thursday 14 November 2019

আল্‌-কুর্‌আনের আলোকে উদ্ভিদের গুরুত্ব



আল্‌-কুর্‌আনের আলোকে উদ্ভিদের গুরুত্ব
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আমরা সকলেই জানি যে, গাছ পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং দূষণমুক্ত সবুজাভ পরিবেশ তৈরি করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্যশস্য ও মৌসুমি ফলমূল উৎপাদনের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণী জগতের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করে। খাদ্য তৈরীর সময় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পরিবেশ হতে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। এছাড়া মানুষের জন্য ওষুধ ও আসবাবপত্র তৈরিতে মূল্যবান উপকরণ জোগান দেয় উদ্ভিদের এই প্রয়োজনীয়তা ও অপরিসীম গুরুত্ব বোঝাতেই মহান আল্লাহ্‌ আল্‌-কুর্‌আনে গাছের নামে শপথ করেছেন—“ত্বিন (এক প্রকার উদ্ভিদ) ও যায়তুনের (জলপাইজাতীয় এক ধরণের ফল) শপথ! [সূরা আত্‌-ত্বিন ১] এবং সূরাটির নামকরণও গাছের নামেই করা হয়েছে।  

প্রাকৃতিক পরিবেশ— আল্‌-কুর্‌আনের ভাষ্য অনুযায়ী, মহান আল্লাহ এই প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের জন্য সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক, বাসোপযোগী অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের অশেষ কল্যাণ ও উপকারের জন্য নানা প্রজাতির পশু-পাখি ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। আরও সৃষ্টি করেছেন নানা ধরণের উদ্ভিদ ও গাছপালা; যা মানুষ সহ প্রাণী জগতের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এবং উদ্ভিদ ও প্রাণি জগতকে বাঁচিয়ে রাখতে জল, বায়ু ও আলোর বন্দোবস্ত করেছেন। তাছাড়া, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করে একদিকে ধরিত্রীর ভারসাম্য রক্ষা করেছেন তো অন্যদিকে নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর সৃষ্টি করে পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রেখেছেন। এবং পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে ঘোষণা  করেছেন—তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। বায়ু মেঘমালাকে সঞ্চারিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা বৃষ্টি পৌঁছে দেন, তখন তারা আনন্দিত হয়। [সূরা আর্‌-রূম ৪৮]

উদ্ভিদ ও শস্য স্রষ্টার এক অমূল্য অনুগ্রহ— ইসলামে হালাল জীবিকা উপার্জন ও জনকল্যাণমূলক বিষয় হিসেবে কৃষিকাজ, ফলদ বৃক্ষরোপণ ও শস্যবীজ বপনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে প্রকৃতির যতগুলো আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ দান করেছেন, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে এই বৃক্ষরাজি। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকা ও বৃহৎ কল্যাণের জন্য গাছপালা, বৃক্ষলতা এবং মৌসুমি ফল-ফসলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে আল্‌-কুর্‌আনের ঘোষণা— “তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি উষর ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে।” [সূরা আস্‌-সাজ্‌দাহ্‌ ২৭]

তিনি মানুষ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ভূপৃষ্ঠে ফলবান বৃক্ষরাজি সবুজ-শ্যামল বনভূমি সৃষ্টি করেছেনএবং এসবের দ্বারা পৃথিবীকে সুশোভিত অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেনগাছপালা দ্বারা ভূমণ্ডল, পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন মর্মে তাঁর ঘোষণাআমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছিএতে প্রত্যেক অনুরাগী ব্যক্তির জন্য জ্ঞান উপদেশ রয়েছেআর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। এবং লম্বা লম্বা খেজুর গাছ; যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। মানুষের জন্য জীবিকা স্বরূপ। এভাবেই আমি মৃত জনপদকে জীবিত করে তুলি।” [সূরা ক্বাফ ১১]  

গাছপালা যে স্রষ্টার বড় আশীর্বাদ আল্‌-কুর্‌আনের একাধিক আয়াতে তার উল্লেখ রয়েছেআল্লাহ্‌ বলেছেন— “অতঃপর বৃষ্টির জল দ্বারা আমি মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষরাজি উদ্গত করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।” [সূরা আন্‌-নাম্‌ল ৬০] উদ্ভিদ থেকে আগুন জ্বালানোর কথার উল্লেখ করে বলেছেন— তিনিই তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন উৎপাদন করেছেন, তা থেকে তোমরা আগুন জ্বালিয়ে থাকো।” [সূরা ইয়াসীন ৮০] গাছপালা থেকে আমরা কেবল কাঠ, ওষুধ ফলমূলই পাই নাগাছপালা থেকে বিভিন্ন রকমের সুগন্ধি দ্রব্য তেলও পাওয়া যায় এ বিষয়ের প্রতি মহান আল্লাহ্‌ এভাবে ইঙ্গিত করেছেন— “(এবং আমি সৃষ্টি করেছি) এমন এক বৃক্ষ, যা জন্মায় সিনাই পর্বতে, তাতে উৎপন্ন হয় আহারকারীদের জন্য তেল ব্যঞ্জন।’ [সূরা আল্‌-মুমিনূন ২০]  

উদ্ভিদ বিষয়ক গবেষণার আহবান— এভাবে তিনি কোরআনের নানা জায়গায় এই বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির বেশ কিছু দৃশ্য মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। যাতে এর বিচিত্র প্রকার, বর্ণ, গন্ধ ও সৌন্দর্য দেখে মানুষ পুলকিত ও অভিভূত হয়। এবং এসবের উন্নতি, অগ্রগতি ও সক্রিয়তা দেখে প্রকৃতি ও উদ্ভিদ জগত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। ঘোষণা করেছেন— “তিনিই তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। সেই জল তোমরা পান করো। এবং সেই জল থেকেই উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, যাতে তোমরা পশুচারণ করো। এবং তিনি ঐ জল দ্বারা তোমাদের জন্য উৎপাদন করেন ফসল, যায়তুন, খেজুর, আঙুর ও সর্বপ্রকার ফলমূল। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” [সূরা আন্‌-নাহ্‌ল ১০ – ১১] অন্য এক জায়গায় রয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শস্যবীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনিই প্রাণহীন বস্তু হতে প্রাণবান বস্তু নির্গত করেন এবং প্রাণবান বস্তু হতে নিষ্প্রাণ বস্তু নির্গতকারী। হে মানব সকল, তিনিই আল্লাহ্‌। সুতরাং তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করে কোন্‌ অজ্ঞাত দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?... তিনিই তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। তারপর ঐ জল দিয়ে সর্বপ্রকার উদ্ভিদচারা উদ্গত করেছেন। তা থেকে সবুজ গাছপালা। তাতে থরে থরে বিন্যস্ত শস্যদানা উৎপন্ন করেন। খেজুর গাছের চুমরি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করেন। আঙুর, যায়তুন ও আনার উদ্গত করেছেন। সেসব একটি অন্যটির সদৃশ ও বিসদৃশ। যখন ঐ গাছ ফল দেয় তখন তার ফলের প্রতি ও ঐ ফলের পরিপক্কতার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করো। এসবের মধ্যে বিশ্বাসী লোকেদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।” [সূরা আল্‌-আন্‌‘আম ৯৫, ৯৯]

পবিত্র কুর্‌আনে বেশ কিছু জায়গায় গাছপালা উদ্ভিদরাজি যে আল্লাহর একটি বিশেষ আশীর্বাদ সে-বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার আহ্বান করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ বলেছেন— মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুকআমি প্রচুর বারি বর্ষণ করিঅতঃপর আমি ভূমিকে ভালোভাবে বিদীর্ণ করে তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাক-সবজি, যায়তুন (তেল), খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফলমূল এবং গবাদিপশুর খাদ্যএটা (আমি করি) তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ভোগের জন্য।” [সূরা আবাসা ২৪-৩২] অন্য এক জায়গায় বলেছেন— তাদের জন্য একটি নিদর্শন হচ্ছে মৃত ধরিত্রী, যাকে আমি জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য যা তারা ভক্ষণ করেতাতে আমি উৎপন্ন করি খেজুর আঙুরের উদ্যান এবং এতে আমি উৎসারিত করি প্রসবন, যাতে তারা এর ফলমূল ভক্ষণ করতে পারেএগুলো তো তাদের হাতে সৃষ্ট নয়তবুও কি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না? [সূরা ইয়াসিন ৩৩৩৫]  

এছাড়া হাদিস শাস্ত্রের নানা গ্রন্থে একাধিক হাদিস বর্ণীত হয়েছে বৃক্ষের গুরুত্ব সম্পর্কে। আলোচিত হয়েছে উদ্ভিদ জগতের নানা বিষয়। এবং নানা ভাবে মানব সমাজকে বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।

[পূবের কলম, ১৫ নভেম্বর, ২০১৯ দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্রে “পবিত্র কুরআনের আলোকে উদ্ভিদের গুরুত্ব” শিরোনামে প্রকাশিত]

No comments:

Post a Comment