Sunday 25 March 2018

মাহমুদ সামী আল-বারূদী


মাহ়্মূদ সামী আল্‌-বারূদী
(১৮৩৯ ১৯০৪ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
জন্ম ও পরিচিতিঃ
আল্‌-বারূদী আধুনিক আরবী কবিতায় নবজাগরণের পথিকৃৎ। প্রকৃত নাম মাহ়্মূদ সামী আল্‌-বারূদী তিনি ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর মিসরের রাজধানী কায়রোয় জন্ম গ্রহন করেন। পিতা হাসান হুসনী বেক এবং মা উভয়ই ককেশীয়। তাঁর এক পিতামহ আল্‌-বুহায়রাহ্‌ প্রদেশের ইতায়িল্‌ বারূদ শহরের মুল্‌তাযিম বা গভর্নর ছিলেন। এ কারণেই তাঁদের নামের সাথে আল্‌-বারূদী শব্দটি যুক্ত হয়।
 
শিক্ষা জীবনঃ
প্রাথমিক শিক্ষা স্বগৃহেই শুরু হয়। সাত বছর বয়সে পিতাকে হারান। আত্মীয়দের সহযোগিতায় ১৮৫১ সালে বারো বছর বয়সে কায়রোর আল্‌-মাদ্‌রাসাতুল্‌ হারবিয়্যাহ্‌ নামের এক সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। অতঃপর ১৮৫৪ সালে ষোলো বছর বয়সে একজন সেনা অফিসার হিসাবে স্নাতক হন।
 
কর্মজীবনঃ
চাকরী সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে তিনি কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। অতঃপর ১৮৫৫ সালে ইস্তাম্বুলে যাত্রা করেন। সেখানেও তিনি সাহিত্য সাধনায় মগ্ন হয়ে পড়েন এবং ফরাসী ও তুর্কী ভাষা ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এমনকি এই তিনটি ভাষাতেই কবিতা রচনা করেন। ১৮৬৩ সালে তদানীন্তন মিসরের শাসক ইসমাইল পাশার সঙ্গে মিসর প্রত্যাবর্তন করে ব্যাটেলিয়ন কম্যান্ডার পদে উন্নীত হয়ে রাজপ্রতিনিধির রক্ষী বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। অতঃপর ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন এবং তাদের সামরিক ব্যাবস্থাপনা সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করেন।
 
সামরিক কর্মব্যস্ততাঃ
১৮৬৬ সালে উসমানী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গ্রীকের ক্রিট দ্বীপে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলে কবি সেখানে প্রেরিত হন এবং অত্যন্ত বিরত্বের সাথে লড়াই করে বিদ্রোহের আগুন প্রশমিত করেন। ফলস্বরূপ আল্‌-বিসাম আল্‌-‘উস্‌মানী (অট্যোমান সাম্রাজ্যের বীরত্বের প্রতীক, উস্‌মানী পদক) দ্বারা সম্মানিত হন। পরবর্তীতে খিদিভ ইস্‌মাইল তাঁকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন এরপর ব্যক্তিগত সচিব। এছাড়া ১৮৭৮ সালে তাঁকে প্রথমে আশ্‌-শার্‌কিয়্যাহ্‌ প্রদেশের,পরে কায়রোর গভর্নর নিয়োগ করা হয়।  
 
শ্রীলঙ্কায় নির্বাসনঃ
১৮৮২ সালে আহ্‌মাদ ‘উরাবীর নেতৃত্বে মিসরীয় সেনা তুর্কি-ককেশিয়ান সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে কবি মিসরীয়দের সমর্থন করেন। ফলস্বরূপ তাকে সিংহল দ্বীপে নির্বাসিত করে হয়। সেখানে, শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বো শহরে সতেরো বছর অতিবাহিত করেন। এই দীর্ঘ অভিবাসী জীবনে নানা বিয়োগান্তিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বহু আপনজন, বন্ধুবান্ধবের শেষ দেখাও মেলেনি। নিজ মাটিকে খুব মিস্‌ করতেন। সেসব কথা তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন।  
 
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও মৃত্যুঃ
১৮ই মে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে খিদিভ দ্বিতীয় ‘আব্বাস হিল্‌মীর শাসনামলে ক্ষমাভিক্ষা লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। মিশরে ফিরে রাজনীতির ময়দান ত্যাগ করে সাহিত্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেন। জীবন সায়াহ্নে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন।
 
রচনাবলীঃ
(ক) তাঁর দীওয়ান (কাব্যগ্রন্থ), দু’খন্ডে সমাপ্ত তাঁর এই কাব্যসংকলনে প্রশান্তিমূলক, প্রেম সম্পর্কিত, গৌরবমূলক, বীরত্বমূলক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কবিতা স্থান পেয়েছে। যার বেশীর ভাগ নির্বাসন কালে রচিত। (খ) মুখ্‌তারাতুল্‌ বারূদী, আব্বাসি যুগের বিখ্যাত তিরিশ জন কবির নির্বাচিত কবিতার সংকলন। এটি চার খন্ডে সমাপ্ত ও সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত।
 
কাব্য প্রতিভাঃ
(ক) রায়েদুশ্‌ শে’রিল্‌ হাদীস (আধুনিক আরবি কবিতার জনক), তিনি আধুনিক আরবি কবিতার ইতিহাসে নবজাগরণের পথিকৃৎ একজন কিংবদন্তী কবি আরবি সাহিত্যের স্বর্ণ যুগ আব্বাসি যুগ-এর সেই প্রকাণ্ড মহীরূহটির শাখা-প্রশাখাগুলি কালক্রমে শুকিয়ে যায়। তিনি সর্বপ্রথম নিজ সৃজনশীল কাব্যের সিঞ্চন দ্বারা মৃতপ্রায় ওই বৃক্ষটিকে নতুন সঞ্জীবনী শক্তি দান করেছিলেন। তাই সার্থকভাবে তাঁকে আধুনিক আরবি কবিতার জনক রূপে অভিহিত করা হয়। ঐতিহাসিক যাইয়াত বলেছেন, আরবি কাব্যকবিতার পথ প্রশস্ত করার কৃতিত্ব ইম্‌রাউল্‌ কায়েসের। পরবর্তীতে কবি বাশ্‌শার সেই পথকে আরও উন্নীত ও সৌন্দর্যায়িত করেন। বহু বছর বাদে, আল্‌-বারূদী সেই পথকে নতুন রূপে, নবীন আঙ্গিকে গড়ে তোলেন।
 
(খ) রাব্বুস্‌ সায়েফ ওয়াল্‌-কালামঃ তাঁর কাব্যগ্রন্থ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দর্পণ। রণাঙ্গনের চিত্রায়ন, যুদ্ধক্ষেত্রের চারপাশের প্রাকৃতিক বর্ণনা, যুদ্ধযাত্রা ইত্যাদিকে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক ও অকুতোভয় সৈনিক এবং কলমের ময়দানে একজন সৃজনশীল ও সফল কবি, তাই তাঁকে অসি ও মসির অধিকারী বলা হয়।
 
(গ) কবিতার বৈশিষ্টঃ তাঁর রচনাশৈলী সহজ সরল ও প্রাঞ্জল। অলঙ্কার শাস্ত্রের বোঝা লাঘব করে আরবি কবিতাকে তিনি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেনতবে প্রাচীন কবিদের কাব্য-শৈলীকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানও করেননি। তিনি সংক্ষিপ্ত শব্দের আবহে ভাব প্রকাশের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিতেন। যদিও তার জন্য কখনো কখনো কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতেন। গৌরবগাঁথা, শৌর্য ও বর্ণনামূলক কবিতায় বেশ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর এক কবিতায় গর্ব করে বলেছেন
فما كنت إلا الليث أنهضه الطوي     وما كنت إلا السيف فارقه الغمد
স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে তিনি একটি কবিতায় বলেছেন
لا لوعتي تدع الفؤاد ولا يدي     تقوى على رد الحبيب الغادي
يا دهــر فيم فجعتني بحليــلة     كانت خلاصة عدّتي وعتادي

No comments:

Post a Comment