Tuesday 20 March 2018

এভাবেই বৈষম্যের শিকার হলাম...!

Image result for discrimination
এভাবেই বৈষম্যের শিকার হলাম...!  
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

সাল ২০০৯-২০১২। তখন আমি স্নাতক স্তরের ছাত্র। থাকি বেকার হস্টেলে। মৌলানা আজাদ কলেজে গ্রাজুয়েশন করছি। আরবি-তে অনার্স। গ্রামের ছেলে এসে পড়েছি শহরে; খালের মাছ সমুদ্রে গেলে যেমন হয় খানিকটা তেমনই আমার অবস্থা। মানসিক ও আর্থিক ভাবে বেশ প্রতিকূল পরিস্থিতিরও সম্মুখীন তখন আমিযাইহোক, অল্প কিছু দিনের মধ্যে দ্বীনের সৌজন্যে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। তবে আর্থিক প্রতিকূলতার অক্টোপাস তখনো জাঁকড়ে রেখেছে আমাকেসে-সময় আমার জেলার এক মহৎ ব্যক্তির কল্যাণে উপায় হল একটি বেসরকারী স্কলারশিপেরপ্রতি মাসে পাঁচ শ' টাকা। তিন মাসের টাকা একসঙ্গে পেতাম হাতে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভেন্যু থেকে সেই টাকা ছাত্রদের মাঝে বণ্টন করা হতো। টাকা আনতে গিয়ে দেখতাম এক অদ্ভুত নাজারা। ইংলিশ-বাংলা-ইতিহাস-ভূগোলের পড়ুয়াদের মাসে ১০০০-১৫০০। বিজ্ঞানের ছাত্রদের ১৫০০-২৫০০। কিন্তু আরবির ছাত্রদের মাসে ৩০০-৫০০ টাকা। এসব দেখে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, এমনটা কেন হচ্ছে? পরিমাণের এই তারতম্যের ভিত্তি কী? আজও তার কোনো উপযুক্ত উত্তর খুঁজে পাইনি আমি...  

সাল ২০০৭-২০০৯। আমি তখন এগারো বারো-র ছাত্র। একদিন জানতে পারলাম একটি মুসলিম সংগঠন মাইনোরটি স্টুডেন্টদের স্কলারশিপ স্বরূপ এককালীন কিছু টাকা দেয়। বেশ মোটা অংকের। শর্ত হচ্ছে, রেজাল্ট ভালো হতে হবে। সৎচরিত্রবান হতে হবে। নামাজ-কালাম ইত্যাদির প্রতি যত্নবানও হতে হবে। আমাকে অনেকে আবেদন করতে বললেন। করলামও। কিন্তু সেই স্কলারশিপটি আমি পাইনি। আমার জেলার বিজ্ঞান পড়ুয়া যে-মেয়েটি পেয়েছিল, তাঁকে আমি চিনতাম। হলফ করে বলতে পারি, এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি, শর্তাবলীর বিচারে মেয়েটি আমার থেকে ঐ স্কলারশিপের অধিক যোগ্য ছিল...!  
     
বেনারস থেকে ফিরে আলিম (মাধ্যমিক সমতুল্য) পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাড়িতে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় চলে গেলাম বেলপুকুর। বেলপুকুর মাদ্‌রাসায় পাঠদানের পাশাপাশি চলল পরীক্ষার প্রস্তুতিও। বেশ নজরকাড়া ফল হল। আলিম পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম। এবার ফাজিলে (উচ্চমাধ্যমিক সমতুল্য) ভর্তি হলাম বাটনা সিনিয়ার মাদ্‌রাসায়। তবে পরিবেশ ও আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথা মাথায় রেখে একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবি পড়ানোর কাজে যোগ দিলাম। পড়ানোর পাশাপাশি চলল নিজের পড়াশুনো। একাজটি আমাকে দেওয়া হয়েছিল আমার জেলার এক মহৎ ব্যক্তির সুপারিশে। তাঁর সততা, মহানুভবতা ও ব্যক্তিত্বে আমি আজও জীবনের রসদ খুঁজে পাই; আরও পাই অনুপ্রেরণা দেশ ও দশের জন্য কিছু করার। তাঁকে অনেকে 'চাচা' বলে ডাকে; কেউ ভালোবেসে, কেউ শ্রদ্ধাভরে, আবার কেউ অবজ্ঞার স্বরে; তাঁর পুঁথিগত ডিগ্রী বা সার্টিফিকেট নেই বলে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব, সততা, নিষ্ঠা, কর্মপ্রিয় ও ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার জন্য আমি তাঁকে 'মইনুদ্দিন স্যার' বলেই সম্বোধন করি। সেই প্রতিষ্ঠানে যে সব দায়িত্ব আমায় দেওয়া হতো তা ঠিকঠাকভাবেই পালন করতাম; একজন শিক্ষক হিসেবে। শুধু একটা হিসেব বুঝতে পারতাম না, এখনো পারি না-- মাইনের অত তারতম্য কেন ছিল, কেন অত বিশাল ফারাক ছিল? কেন অমন বৈষম্য আমার বরাতে জুটেছিল...! 

তারপর এক লম্বা সফর..., 
এখন আমি তিলোত্তমার বুকে একটা সরকারী চাকরি করি। অধ্যাপনা করি এক গভর্নমেন্ট কলেজে। আমার অনেক বন্ধু স্কুল-মাদ্‌রাসায় শিক্ষকতা করেন। এসব জায়গায় বাংলা-আরবি-ইতিহাস পড়ালে কম, বা ইংলিশ পড়ালে মাঝারি মানের, এবং ফিজিক্স-কেমেস্ট্রি-ম্যাথ পড়ালে বেশি মাইনে দেওয়া হয়-- এমনটা কিন্তু নয়। এমনকি সরকারী স্কলারশিপ- মাইনোরটি বা মেরিট-কাম-মিন্সেও এই তারতম্য নেই। জে-আর-এফের মূল রাশিতেও নেই। তাহলে অমন বৈষম্যের শিকার কেন হতে হয়...?


  তপ্সিয়া, কোলকাতা
১৯-০৩-২০১৮

No comments:

Post a Comment