বদিউর রহমান
ছাতা বস্তুটার কুষ্টিতে লেখা আছে হারানো। হারানোটা হল তার ধর্ম। জিনিষটার জন্মলগ্ন
থেকেই ঐ প্রবনতা স্বভাবজাত। ওটা তৈরী হয় রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নয়, হারানোর
জন্য। তা না হলে প্রায় সকলকে বলতে শুনি কেন যে তিনি প্রায়ই ছাতা হারান। অবশ্য কিছু
হারালে সেটা কারও না কারও পাওয়ার কথা। জিনিসটা তো আর উবে যায় না। যে ছাতাটি আপনি
হারালেন সেটা তো কেউ না কেউ
পেয়ে থাকবেন। তাই বলে কি ছাতা
হারালে কি দুঃখ করবেন না, অথবা তার
খোঁজও করবেন না। ছাতা তো আর গরু নয় যে তার জন্য গরু খোঁজা করতে হবে।
বিখ্যাত ছোটোগল্প লেখক হেনরীর The cop and The anthem গল্পটার
কথা মনে আসছে ? সেখানে একটা ভবঘুরে
চরিত্র ঠান্ডা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফন্দি আঁটছিল আগত প্রায় শীতকালটা যে কোন উপায়ে জেলের ছাদের তলায় সরকারী বদান্যতায় কম্বলের মধ্যে
কাটাত। তার জন্য যে যে কয়েকটি উপায়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে যাওয়ার ফন্দি এটেছিল
তার মধ্যে অন্যতম ছিল একটা শোরুমের বাইরে ছাতা রাখার জায়গা থেকে একটা ছাতা তুলে নিয়ে
সেখান থেকে চম্পট দেওয়ার ভান করা – যাত ছাতার মালিক ব্যাপারটা নিয়ে কেলেঙ্কারী বাধায় ও তাকে
পুলিশের হাতে তুলে দেয়! কিন্তু ভবঘুরে ঐ ছাতা তুলে নিলে কেউ তাকে বাঁধা দেয়নি। কেবল একজন মৃদুস্বরে বলেছিলেন ‘যদি ওটা আপনার হয় আপনি নিতে পারেন কেন না যদিও উনি সেটা ব্যবহার
করেছিলেন কিন্তু ওটা আর নিজের পয়সায় কেনা নয় – এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ পড়েছিল বলে তিনি তার সৎব্যবহার করেছিলেন
মাত্র’। ভবঘুরে অগত্যা
ছাতাটা নিতে বাধ্য হয়, কিছুদুর গিয়ে সেটা ছুড়ে ফেলে দেয়। কেননা তার তো ছাতার
প্রয়োজন নেই, তার উদ্দেশ্য হল
যে কোন উপায়ে জেলে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা। ইংল্যাণ্ডে খোলা
আকাশের নীচে পার্কের ব্যাঞ্চে শোওয়ার বদলে জেলের মধ্যে শীতকালটা তুলনামূলক ভাবে আরামদায়ক।
দেখলেন তো ব্যাপারটা! এক ব্যক্তি ছাতা হারালো, সেটা অন্যের হাতে গিয়ে আবার এক ভবঘুরের হাতে পৌঁছাতে দেরী
হলনা। তাই বলেছিলাম ওই বস্তুটা হারানো যেমন স্বাভাবিক আবার সেটা অন্যের হাতে বেমালুম
পৌছানও অস্বাভাবিক নয়।
আর ছাতা কি এমন অমূল্য বস্তু যে হারালো তার জন্য হাপিত্যেস
করতে হবে। ওর আসা যাওয়াটা খুব সহজ সরল ভাবে নিতে হয়। এলে অত্যাধিক উল্লসিত
হওয়ার কারন যেমন নেই, চলে গেলে বিষন্ন হওয়ারও কিছু নেই। দেখুন না এই সেদিন
শুনলাম আমাদের কর্মচারী সমবায় সমিতি থেকে বাৎসরিক লাভ ক্ষতির হিসাবের পর প্রত্যেক
সদস্যকে একটা করে ছাতা দিচ্ছে। লোভের বশে সেখানে সুড়ৎ করে হাজির হয়ে দেখি পুরুষ ও
মহিলাদের ব্যবহার্য দুধরণের ছাতা রাখা আছে, যার যেমন ইচ্ছা একটা নিতে পারেন। আমি
পুরুষ দের ছাতা চাইলে বেশ কয়েকটা কালো ছাতা আমার সামনে রাখা হল, তার মধ্যে থেকে
দেখেশুনে একটা জুতসই ছাতা আমি তুলে নিই। সমিতির ঘরছাড়ার মুহুর্তে হঠাৎ মনে হলো
আমার তো একটা ছাতা আছে আবার একটা পুরুষের ছাতা নেওয়া কি ঠিক হলো? কথাটা মনে উঁকি
দিতে সমিতির বন্ধুদের বলে রাখলাম ‘বাড়িতে মেয়েদের ছাতা প্রয়োজন থাকলে আগামীকাল
পাল্টে নেব’। আজকাল কি হয়েছে জানেন? সামান্যতম ব্যপারেও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারি
না। নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। সব যেন গোলমেলে মনে হয়। তাই বাড়ির লোকের কথা
মেনে চলি, আর তাতে অন্য যত ক্ষতিই হোক বাড়িতে শান্তি বিরাজ করে। সামান্য ছাতা নিয়ে
গৃহবিবাদ আমার পছন্দ নয়।
সমিতি থেকে পাওয়া ছাতাটা বাড়িতে দেখালাম। ছোট সুখী
পরিবারের স্ত্রী কন্যা দুজনায় পুরুষদের ব্যবহার্য ছাতা নেওয়াতে কোন আপত্তি করল না।
বলল ওটা নেওয়া যুক্তিযুক্ত হয়েছে। ওদের নাকি ছাতার প্রয়োজন খুব একটা হয় না।
বৃষ্টি-বাদলে যা হোক কিছু একটা মাথায় দিলে চলে যায় – একটা খাতা বা পেন হলেও তারা
মাথা রক্ষা করতে পারে। তাছাড়া ওদের ছাতা নিয়ে চলতে বড় সেকেলে লাগে। আর আমার
সম্পর্কে তাঁদের ধারণা হল, আমার রুচিবোধ বলে কিছু নেই, যুগোপযোগী আদৌ হয়ে উঠতে
পারিনি, চলাফেরা সবটাতেই গ্রাম্য-গ্রাম্য সেকেলে ভাব। আর আমার জন্য ছাতা হলো
অপরিহার্য – রোদের সময় প্রয়োজন মাথাভর্তি টাক বাচানোর জন্য আর বর্ষায় প্রয়োজনের তো
কথায় নেই। একবার ভিজে নাকি সাতদিন সকলকে জ্বালিয়েছি। যাই হোক আমার সমিতি থেকে ছাতা
নেওয়ার ব্যপারে আমার পছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় বাড়িতে বকুনি খাওয়ার যে ভয়টা কালো
মেঘের মত বুকের মধ্যে জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল তা দূর হলো। আপাতত নিশ্চিত।
ভেবেছিলাম নতুন ছাতাটা রেখে পুরোনোটা দিয়ে এ বর্ষাটা
কাটিয়ে দেব। তা কী আর হবার জো আছে। দু দিনের মধ্যে ব্যবহার করার ছাতাটা কোথায় যে
ফেললাম তার আর হদিস করতে পারলাম না। ওটা নিশ্চয় কারও কাছে বহাল তবিয়তে আছে। তা
থাক, আমার তাতে আপত্তি নেই। আমি এখন একটা নতুন ছাতা সমিতি থেকে পেয়েছি। এটা দিয়ে
কাজ চলবে। কিন্তু আগের ছাতা ও তারও আগের আর একটা ছাতার সঙ্গে একটা মধুর সম্পর্ক
ছিল। দুটো ছাতার প্রাপ্তিযোগ হয়েছিল শ্যালিকার কাছ থেকে। সে নাকি উপলব্ধি করেছিল
আমার মতো টাক মাথা মানুষদের ছাতা ছাড়া চলাফেরা করা খুব কষ্টকর। তাই করুণারবশত ছাতা
দান।
তার কাছ থেকে প্রথম ছাতাটা পেয়ে খুব উৎফুল্ল হয়েছিলাম। গরু দান করলে অতটা আনন্দিত হতাম কি না সন্দেহ আছে, রোদ-বৃষ্টিতে কাকভেজার পর মনস্থির করলাম আর নয়, ওটাকে সারাতেই
হবে। আমার কর্মস্থলের অনতিদূরে সারিসারি ছাতার দোকান। সেখানে নতুন ছাতা
বিক্রি ছাড়াও পুরানো ছাতা সারানোর লোকও সারি দিয়ে বসে থাকে।
যেদিন ছাতা সারানোর দৃঢ়
প্রত্যয় নিয়ে অফিস বেরলাম সেদিনও ব্যাগের মধ্যে এটা নিতে ভুলিনি। স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন অবরোধ। নিত্যযাত্রী বন্ধুদের
সঙ্গে স্টেশনে কিছুক্ষণ ধরে ট্রেন চলাচলের অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান ভাড়া বৃদ্ধি অথচ নিম্নমানের পরিষেবা, যাত্রীদের দুর্যোগ, রেলকর্তাদের অকর্মণ্যতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, কর্মবিমুখতা ইত্যাদি
নানা বিষয়ের উপর আলোচনা চলতে চলতে বর্তমান রাজনীতিতে এসে ঠেকল। তার সঙ্গে আমরা যে কাজের মানুষ অথচ কাজে যাওয়ার ব্যবস্থাটি সচল রাখতে পারছেন
না বলে রেলকর্তা, রাজনীতিবিদদের মুন্ডুপাত করতে করতে একভাঁড় করে চা খাওয়া হল। স্বাস্থ্য পান করার মতো চা পান করার সময় অবশ্য ভাঁড়ে ভাঁড়ে ঠোকাঠুকি করা হয়নি। ভাঁড়গুলো মাটির বলে অথবা চা গরম বলে কিনা জানি না। চা পান পর্বের
সময় রাজনীতির ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নতার বুলি ঝেড়ে যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা
দিলাম। কাজে যেতে না পারার কপট ক্ষোভ জাহির করে মনের আনন্দে বাড়ি ফেরার পথে ছাতা সারানোর
কথা মনে পড়ল। ভাবলাম আজ তো অফুরন্ত সময়, এখানে একবার দেখি না, ওটা সারানো যায় কিনা। এক স্থানীয় দোকানে
গেলাম। আমার ছাতাটা মিস্ত্রিকে দেখাতে সে খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখে বলল ‘বার শিকের ছাতা’। ওটা আমি বহুদিন
ব্যবহার করেছি সত্য, কিন্তু তার কটা শিক বা শিঙ আছে তা লক্ষ্য করার সৌভাগ্য আমার
কখন হয়নি। বললাম, ‘বার শিকের তো কি
হয়েছে ! কাপড়টা পাল্টে
আর একটু ঠিকঠাক করতে পারবে কি?’ সে বলল বার শিকওয়ালা ছাতার কাপড় ওর কাছে নেই। সাধারণ ছাতা হলে সারিয়ে দিতে পারত। আমার (অসাধারণ) ছাতার কাপড় কলকাতায়
অর্ডার দিয়ে আনিয়ে কাজ করতে হবে। সপ্তাহখানেক সময়
লাগবে।
অতএব আমি আমার অসাধারণ, দুর্লভ বস্তুটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে আরও এক ছাতা মিস্ত্রিকে দেখে তার কাছে গেলাম। সে অনেক্ষণ গবেষণা
করে বলল যে সে ঐ ছাতার কাজ করতে পারবে না। সে অত দক্ষ নয়। তার দাদা পাকা মিস্ত্রি। তিনি অন্য কাজে
বাইরে গেছেন। ঘন্টা দুয়েক পরে আসবেন। ছাতার জন্য কে
আর দু ঘন্টা বসে থাকে। ভাবলাম আগামীকাল তো নিজেই কলকাতায় যাব তখন দেখা যাবে মনে
করে বাড়ি চলে গেলাম। পরের দিন অফিস যাওয়ার পথে স্টেশনের কাছে ‘টুকিটাকি’ দোকানের বারান্দায়
একজন ছাতামিস্ত্রিকে দেখতে পেয়ে কি মতিভ্রম হল জানি না ভাবলাম ওকে একবার জিজ্ঞাসা করে
দেখি। সে ছাতাটা নিয়ে অনেক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। আমি অসহিষ্ণু হয়ে
উঠছি নটার ট্রেনের সময় হয়ে আসছে বলে। বললাম ‘কী
সারাতে পারবে?’ দার্শনিক সুলভ চাহনি দিয়ে বললো – ‘বলেন কি? আমি পারবো না তো কে
পারবে?’ জিজ্ঞেস করলাম ‘তা কত লাগবে?’ উত্তর এল ‘নব্বই টাকা’। অবাক হয়ে বললাম ‘বল
কি! নব্বই টাকা! ঐ টাকায় তো একটা নতুন ছাতা হয়ে যাবে’। মিস্ত্রি বলল, ‘তা হয়ত হবে,
কিন্তু এ জিনিষ কি পাবেন?’ সবিস্ময়ে বললাম ‘তার মানে?’ মুহূর্তের মধ্যে শ্যালিকার
প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠল। অত মূল্যবান বস্তু এই নগণ্য ব্যক্তিকে প্রদান। আর
ভাববার মতো অবস্থা ছিল না, সময়ও ছিলনা ট্রেন ধরার তাড়ায়। বুকে ঠুকে সাহস করে
মিস্ত্রিকে বললাম ‘তা নব্বই টাকা দেব কিন্তু কাজটা ভাল করে করবে। সন্ধ্যাবেলা
ফেরার পথে ছাতাটা নিয়ে নেব’।
সারানোর পর ছাতাটা ব্যাগের মধ্যে অতি যত্নে আমার সঙ্গে
দু তিন দিন যাওয়া আসা করছিল। তাকে ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। একদিন অফিস
যাওয়ার সময় ঘর থেকে বেরনোর পর মাঝপথে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে ছাতাটা খোলার
চেষ্টা করলে বিফল হই। প্রায় কাকভেজা অবস্থায় অনেক কসরৎ করে ওটাকে খলতে সমর্থ হলাম।
মিস্ত্রির উপর রাগটা শানাতে শানাতে স্টেশনের দিকে জোরে সাইকেল চালাতে লাগলাম। ওর
কাছাকাছি পৌঁছাতে সাইকেলের সীটে বসে একটা পা মাটিতে তেরচা করে ঠেকিয়ে রেখে ছাতাটা
না খোলার সমস্যটা মিস্ত্রিকে সংক্ষেপে বললাম। সে আবারও দার্শনিকের মতো হয়ে গেল,
যেন উচ্চমার্গের কোন জটিল বিষয়ের সমাধানে মগ্ন। তার ঐ রকম অবস্থা দেখে আর আমার
ট্রেন ধরার তাড়া থাকার জন্য তার ধ্যানভঙ্গিদের আমাদের কাদামাটির জগতে ফিরিয়ে আনতে
বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাড়াতাড়ি বলো এটা ঠিক হবে কিনা?’ সম্বতি ফিরে পেয়ে সে গম্ভীর স্বরে বলল ‘ওটা ওরকমই হবে’।
তখন আমার অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। বাকরুদ্ধ অথচ রাগে গরগর
করতে করতে ট্রেন ধরার জন্য সম্মুখ পানে এগিয়ে যাই। ট্রেনের এক নিত্যযাত্রী সঙ্গিকে
কথাটা বলে বুকটা হাল্কা করতে চাইলাম। সব কথা শুনে সে বলল ‘তোমার যেমন আক্কেল! তুমি
গেছ ওর কাছে! আরে ও তো ছাতা মিস্ত্রি নয় ও হলো ইঞ্জিনিয়ার। বয়েস হলে মানুষের
ভিমরতি হয়, তোমার দেখছি তাই হয়েছে। তোমার এটুকু জ্ঞান নেই যে ঐ টাকায় নতুন ছাতা
হয়?’ আমি সহযাত্রীর কাছ তাড়া খেয়ে মিড় মিড় করে বলতে গেলাম ‘ওরা বলল ওটা বিদেশী অমন
জিনিষ... কথাগুলো শেষ করতে না দিয়ে বন্ধুবর বলল ‘ঐ সব প্যানপ্যানানিগুলি রাখ তো!
আমরা ট্রেনে এক কাপ চা খেতে চাইলে তোমার তখন মরা কান্না ‘মাসের শেষ, লক্ষ্মীবারের সকাল, কাল শনিবারের বারবেলা…’। ঠিক হয়েছে। আর কাউকে বলতে যেওনা তোমার মূর্খামির কথা। লোকে হাসবে’। ঐ জাতীয় কথা জীবনে
প্রথমবার শুনলাম তা নয়। বাড়িতে, আপিসে, রাস্তাঘাটে অনেকক্ষেত্রে ঐ রকম মন্তব্য শুনে শুনে আমারও বিশ্বাস
জন্মে ছিল যে আমি একেবারে নিরেট…। তাই অত টাকায় ছাতা সারানোর কথাটা তৃতীয় কাউকে বলতে পারিনি। স্ত্রীকে তো নয়ই। ছাতাটাকে ঠিক করাতে কলকাতায় আবার গোটা কুড়ি টাকা গচ্চা দিয়েছিলাম। তা হোক। ছাতাটার প্রতি ইয়ে, মানে এক ধরণের দুর্বলতা – বলতে পারেন ভালবাস – জন্মেছিল। তার পিছনে কারনটা
গোপন হলেও বোকার মত আগেই বলে ফেলেছি। কিন্তু অমন প্রিয়
ছাতাটা কি আমার কাছে থাকল? থাকল না। হারিয়ে গেল।
ঐটা হারানোর পর দুঃখের কথা শ্যালিকাকে বলতে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা
ছাতা আমার হাতে তুলে দিয়েছিল ‘জানতাম আপনার মতো ভুলো ওটাকে হারাবেন। তাই আর একটা কিনে রেখেছি আপনার জন্য। এটাকে যেন আর হারাবেন
না’। আমার প্রতি এত
মায়া মমতা দেখে চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠেছিল। এ জগতে এখনো এমন
মানুষ আছে যে আমার সুখদুঃখের কথা মনে করে ছাতার পর ছাতা দান করে। আমার কী পরম সৌভাগ্য।
যাই হোক এই দ্বিতীয় ছাতাটাকেও ধরে রাখতে পারলাম? সমবায়ের ছাতাটা
পাওয়ার পরপরই দ্বিতীয়টাও হারালাম। সেটা আর আমার কাছে থাকল না। অমন বিশেষ একজনের
কাছ থেকে পাওয়া জিনিষটা হারালে বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, কেমন টনটন করে ওঠে।
কিন্তু উপায় তো নেই। মনকে সান্ত্বনা দিই অত দুঃখ করার কি আছে? আমার যেটা হারিয়েছে
সেটা তো কেউ পেয়েছে। অতএব মন আমার, অত উতলা হোস নারে বলে প্রবোধ দিতে থাকি। বড়
সান্ত্বনা হল আমিও তো আর একটা ছাতা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। সমবায়ের ছাতা। আরে জগতটা
হলো, কি যেন বলে না... ‘দিবে আর নিবে মিলিবে মিলাবে...’। একটা হারালাম তো অন্যটা
এসে গেল। তাতেই শান্তি।
তবে সত্যিকারের প্রশান্তি এল অন্যভাবে। সমিতির মাধ্যমে
নিজের প্রাপ্তির থেকে বেশি। তৃপ্তি পেলাম এক সহকর্মীকে ছাতা পাইয়ে দিয়ে। আমার হাতে
চকচকে নতুন ছাতা দেখে তার দাম কত, কোথা থেকে কিনলাম ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করলে বললাম
যে ‘আমি আমাদের সমিতির বলে ওটা বিনা পয়সায় পেয়েছি, কিনিনি। আর সমিতি সব সদস্যকেই
প্রতি বৎসর কিছু না কিছু উপহার দিয়ে থাকে’। কথাগুলো শোনা মাত্র তিনি প্রায় চিৎকার
করে উঠলেন ‘আমিও তো সদস্য। কই আমাকে তো কখনো ওরা কিছু দেয়নি। তাহলে আমার দশ বারো
বছরের জিনিষগুলো গেল কোথায়?’ তার মুখ নিঃসৃত ভাষায় বলতে হলে ‘আপ লোগুকো সূচনা দেতা
হ্যায়, হামকো কিউ নেহি সূচনা দেতা?’ আমি যতই বলি সমিতি নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দিয়ে
সাধারণভাবে সকল সদস্যকে জানায়, ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে অবহিত করার কোন প্রশ্ন নেই’।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। তার রাগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। তাকে ঠাণ্ডা করার জন্য এক
কাপ গরম চায়ের কথা বলতে উনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে একবার চলুন তো
সমিতির ঘরে’। আমি বলি ‘কারও সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি তো সদস্য। ওখানে গেলে
আপনার প্রাপ্য ছাতা ওরা আপনাকে দিয়ে দেবে’। কিন্তু ভদ্রলোকের সেই এক কথা, ‘চলিয়ে
হামারা সাথ’। আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম ‘পড়েছি মোঘলের হাতে...’ ওঁর সঙ্গে যেতে
হলো। ভয় হচ্ছিল উনি যা রাগী মানুষ আমাকে না অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ও
মা, কি অবাক কান্ড। যিনি এতক্ষণ এত আস্ফালন করছিলেন তিনিই এখন পূর্ণ শালীনতা বজায়
রেখে বরফ গলা জলের মতো ঠাণ্ডা স্বরে কথাবার্তা বললেন। তারপর একটা ছাতা বগলদাবা করে
রাজ্য জয় করার মত বুক ফুলিয়ে সমিতি থেকে বেরিয়ে এলেন। ফেরার সময় আকারে ইঙ্গিতে
বলতে ছাড়লেন না ‘আমারা কী রকম বন্ধু যে বছরের পর বছর সমিতির উপহারে নিজেদের ঘর
ভরিয়ে ফেললাম আর ওঁকে খবরটুকু দেওয়ার সামান্যতম সৌজন্যটুকু দেখাই না’।
কথাটা মনে বাজলো, সত্যি তো মানুষ জন্মই বৃথা যদি কারও
উপকারে না আসি। তক্কে তক্কে ছিলাম মানবজনম স্বার্থক করতে হবে পরোপকার করে। করতেই
হবে। আর মন ভালো কাজ করার প্রত্যয় জাগলে ঈশ্বর অন্ধজনকেও পথ দেখায়। আমিও একজন
সহকর্মীর সাক্ষাৎ পেলাম। এই স্বনামধন্য ব্যক্তির কথা বলি। উনি কিছুটা উদাসীন
প্রকৃতির মানুষ। তিনি একদিন কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছেন তখন অঝোরে
বৃষ্টি আরম্ভ হতে বললেন বাড়ি থেকে ছাতাটা আনতে ভুলে গেলাম আর আজই এরকম বৃষ্টি
নামল। মনে হচ্ছে আজ ভিজতে হবে’। সুযোগ এসেছে দেখেই তখনই একটা পরোপকার করার ইচ্ছা হল। ওঁকে
জিজ্ঞাসা করলাম ‘আপনি কি আমাদের সমবায়ের
সদস্য?’ উত্তর এলো ‘দীর্ঘ তিরিশ বৎসর যাবৎ সদস্য’। সমিতির ছাতা পেয়ছেন কিনা জানতে
চাইলে উনি আকাশ থেকে পড়লেন। উনি বিস্মিত হয়ে বললেন সমিতি ছাতা দেয় নাক? তখনই তাঁকে
সঙ্গে করে সমিতির ঘরে নিয়ে যেতে উনি পেলেন একটা সুন্দর ছাতা। আমি পেলাম এক রাশ
চায়ের প্রতিশ্রুতি আর একটা সুন্দর গল্প। তার এক শিক্ষক বন্ধু ছাতা হাতে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে রাস্তায় বৃষ্টি আসতে ছাতাটা মাথায় দিয়ে পথ চলছিলেন। বৃষ্টির বেগ প্রবল হলে
পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে যাচ্ছিল। একটা বড় বাড়ির পোর্টিকোর তলায় অনেকে দাঁড়িয়ে
ছিল বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ঐ শিক্ষকমশায়ও সেখানে একটু দাড়ালেন বৃষ্টিটা একটু
ধরে আসার আশায়। মাথার ভিজে ছাতাটা বন্ধ করে রাখলেন পাশের লোহার রেলিংএ। কিছুক্ষণ
পর বৃষ্টি একেবারে থেমে গেল। শিক্ষকমশায় গুটি গুটি এগিয়ে চললেন ইস্কুলের দিকে।
ছাতাটা পড়ে রইল রেলিং-এ শুকানোর জন্য।
ছাতার নিয়তি হল ঐ রকম। বৃষ্টিতে তাকে মনে পড়ে বৃষ্টি
থেমে গেলে তাকে ভুলে যাই। অবশ্য ওটা তৈরি হয় হারানোর জন্য বেশি, ব্যবহারের জন্য
কম। তবে ছাতা হারালেই যে নতুন আর একটা ছাতা কিনতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিছু
বুদ্ধিমান ব্যক্তি আছেন যারা নিত্যনৈমিত্ত নতুন নতুন ছাতা এমনকি নতুন চপ্পল
ব্যবহার করেন কিন্তু সেগুলো নাকি সব সময় তাঁদের কেনা বস্তু নয়। কথাবার্তায় বেশ
চৌখশ একজনকে দেখতাম ঐ রকম। ভেবেছিলাম শৌখিন মানুষ তাই নিত্য নতুন ছাতা ও চপ্পল
ব্যবহার করেন। কয়েকদিন তার শৌখিনতার তারিফ করতে একদিন মন্ত্রগুপ্তির পাঠ দিলেন
অতীব চুপিসারে, কানে কানে। ‘সেই কানে কানে বলা রেখে যাব এইখানে – অনন্তের কানে’।
বলেছিলেন যে উনি সভা সমিতি বিশেষ করে যেখানে নামগান ইত্যাদি হয় সে সব জায়গায়
প্রায়শই যাওয়া আসা করেন। (আমি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে ওঁর ধর্ম—কর্মের
বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা আছে। নির্ঘাত ধর্মপরায়ন দেবতুল্য মানুষ। ওঁর পায়ের ধুলো নিতে
হবে)। কিন্তু তারপর যা বললেন শুনে আমার চক্ষুস্থির। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন
যে ‘আপনাকে বলে বলছি – ঐ সব জায়গায় মানুষজন ভক্তিভরে জুতো ছাতা ইত্যাদি বাইরে রেখে
ভিতর দালানে যায়। বেরনোর সময় পছন্দমতো একটা নিয়ে মেজাজে বেরিয়ে এলেই হলো। ছাতা আর
খবরের কাগজ কিনতে হয় নাকি? ওগুলো তো বোকারা কেনে আমার মতো মানুষ ব্যবহার করে’।
কিন্তু আমি কি ঐ শিক্ষা আপনাকে দিতে পারি? আপনি বরং ছাতা
হারালে গাঁটের নগদ পয়সা খরচ করে কিনে নেবেন। শুধু তাই নয়। সজ্ঞানে কিনবেন যে যেটা
কিনছেন সেটাও দুদিন পর হারাবে। থাকবে না। আর না হারালে ছাতাওয়ালাদের চলে কি করে।
দত্ত বলুন বা পাল বলুন নামী-অনামী অনেকে
তো ঐ ছাতা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাই ছাতা তুলে বেশি কিছু বলব না কেননা তার
যেমন ব্যবহার আছে অপব্যবহারও আছে। জানি বেশি কিছু বললে কোম্পানীর লোক মানহানীর কেস
ঠুকে দেবে বা ছাতা শ্রমিক বন্ধুরা আমার পিছনে ছাতা উঁচিয়ে তেড়ে আসবে। সেই দলের
সকলের শেষে হয়ত দেখতে পাব সে লোকটাকে যার তীক্ষ্ণ স্বর প্রতি
গ্রীস্মে ও বর্ষায় প্রায়ই আমাদের গলিতে শুনতে পাই ‘হাতা হারাবেন?’ (যা আসলে ছাতা
সারাবেন?)।
মন্ত্রমুগ্ধের মত এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম
ReplyDeleteAwesome writing sir😃
ReplyDelete