টাইমবাবু
বদিউর রহমান
তপন ভট্টাচার্যির পিতৃদত্ত নামটা প্রায় সকলেই ভুলে গিয়েছেন। উনি আমাদের পাড়ায় ‘টাইমবাবু’ নামে সমধিক পরিচিত। আমাদের বাস ডিপোর ‘স্টার্টার’ তপনবাবু কুড়ি-একুশ বছর বয়সে
ওই কাজে যোগ দেন। আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখন থেকে তাঁকে বাস ডিপোর চার-বাই-চার আর উচ্চতায়
সাড়ে পাঁচ কাঠের তৈরী গুমটি ঘরে বসে থাকতে দেখেছি। যখন মর্নিং কলেজে
ছ’টার বাস ধরতাম
তখনও যথারীতি তপনবাবুকে ঐ ছোট পরিসরের খুপরিতে জানালার পিছনে বসে নিজের কাজ করতে দেখেছি। ততদিনে জানতে পেরেছিলাম উনি আমাদের বাস ডিপোর চারটে রুটের একমাত্র ‘স্টার্টার’।
ওঁর কাজ ছিল কখন কোন বাস ছাড়বে তা নির্ণয় করা। বাস ছাড়ার জন্য নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পূর্বে একবার হুইসল বাজিয়ে ড্রাইভার-কণ্ডাক্টরদের সতর্ক
করতেন। আবার ঠিক পাঁচ মিনিট পরে বাসটাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আরেকবার হুইসল বাজাতেন। ঐ সব ব্যাপারগুলো এত চমৎকার ভাবে সময় ধরে করতেন যে ওনার কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য
রেখে নাম হয়ে যায় ‘টাইমবাবু’।
দীর্ঘদিন আমাদের ডিপো থেকে বাস ধরার সুবাদে টাইমবাবুর সাথে
কিঞ্চিৎ পরিচয় হয়েছিল। ছাত্রজীবনে শীত-বর্ষায় কখনো কখনো ছ’টার বাসটা ধরতে পারতাম না। টাইমবাবুর কাছে
পরবর্তী বাসটার কথা জিজ্ঞাসা করলে তার ছাড়ার সময় ও গাড়ির নাম্বার বলার পর কখনো কখনো
কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। কলেজ, পড়াশোনা ইত্যাদি সম্পর্কে দু’একটা প্রশ্নও করতেন। দু’একবার সময় সম্পর্কে
প্রচ্ছন্নভাবে সচেতন হতে বলেছেন। বয়স কম ছিল; সময়ানুবর্তিতার
অযাচিত উপদেশে কখনো কখনো বিরক্ত হতাম। ছাত্রজীবন অতিক্রান্ত
করে শিক্ষকতা করার সময়ও দীর্ঘদিন টাইমবাবুকে তাঁর কর্মে নিষ্ঠার সঙ্গে গুমটির মধ্যে
বসে দায়িত্বসম্পন্ন করতে দেখেছি। চোখাচোখি হলে হেসে
বলতেন ‘ভাল থেকো’। ততদিনে ওকে অতীব
সদাশয় শিষ্ট ব্যক্তি বলে প্রত্যয় জন্মেছিল।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সবসময় টাইমবাবুকে দেখতাম নিজের কাজ সকাল ছ’টা থেকে রাত আটটা
পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে যেতে। ভোরে স্নান ও প্রাতঃরাশ
সেরে পৌনে ছ’টায় বাড়ি থেকে
বের হতেন, ফিরতেন রাত সাড়ে
আটটার আগে নয়। ওঁর দায়িত্ববোধ ছিল অস্বাভাবিকভাবে বেশী। চারটে রুটের চব্বিশটা
গাড়ির সময় অনুযায়ী আসা যাওয়ার ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখতেন বিশেষ গুরুত্ব সহকারে। বলতেন যে সবকিছু সময় অনুযায়ী না চললে বহু মানুষের প্রয়োজনীয় কাজ বানচাল হয়ে
যেতে পারে; ছাত্রদের স্কুল-কলেজে দেরী হতে
পারে; কর্মচারীদের আপিসে
আর মহিলা ও বাচ্চাদের বা অসুস্থ ব্যক্তিদের অহেতুক দুর্গতির সম্মুখীন হতে হবে। তাই কোনো রুটের বাস হঠাৎ খারাপ হলে উনি ব্যক্তিগতভাবে তৎপর হয়ে সময়-সারণী
অনুযায়ী অন্য বাস ছাড়ার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতেন দক্ষতার সঙ্গে। কিছু ফাঁকিবাজ বাসকর্মচারী
ঐরকম সুশৃঙ্খল অথচ আপোষহীন ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য টাইমবাবুর বিরুদ্ধে
টিপ্পনী কাটতে ছাড়ত না। রসিকতা করে বলতো, “বেটা নিজেকে মনে করে বিশ্বকর্মা! জগত সংসারের সব দায়দায়িত্ব যেন ওর ঘাড়ে।” আমাদের ডিপোর সুষ্ঠু পরিষেবার পিছনে যে ঐরকম একজন দায়িত্বশীল
ব্যক্তির নিরলস প্রয়াসের ভূমিকা আছে তা অনেকের গোচরে আসেনি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক
স্বার্থ অবলীলায় ত্যাগ করে কর্মজীবনের দায়িত্বকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার আদর্শ মানুষটা
প্রায় সকলের অলক্ষ্যে থেকে গেছেন অথচ তাঁর কর্মফল আমরা নিয়মিত ভোগ করেছি। ঐরকম নিষ্ঠাবান মানুষটাকে কখনো ভুলেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার প্রয়োজন মনে করিনি। ঐ জাতীয় কাজগুলো তো সাধারণতঃ ‘থ্যাঙ্কলেস জব’!
টাইমবাবুর কাজ উল্লেখযোগ্য চাকরীর মধ্যে গণ্য না হতে পারে
কিন্তু মানুষের যাত্রাপথের পরিষেবাকে মসৃণ, সুনিশ্চিত ও সুশৃঙ্খল করার পিছনে তাঁর করণীয় কাজটা তপনবাবু
দীর্ঘ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর
দৃষ্টান্তমূলকভাবে করে গেছেন। সকালে ডিপোয় পৌঁছান
আর রাতে ফেরেন। দুপুরের খাবার কর্মজীবনে বাড়ীতে গ্রহণ করেননি। দুপুরের দিকে বাসের
চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম থাকে বলে একটা থেকে দেড়টার মধ্যে বাড়ী থেকে পাঠানো টিফিনবক্সের
ভাতটা খেয়ে নিয়ে আবার পরিষেবার দিকে মনোনিবেশ করতেন। ঐরকম নিষ্ঠাবান
কর্মীর জীবনে সংসারধর্ম সুচারুভাবে করা হয়না। টাইমবাবুর পক্ষেও
তা যথাযথভাবে করা সম্ভব হয়নি। প্রতি মাসের টাকাটা
স্ত্রী মালতীর হাতে তুলে দেন। ঘরসংসারের সব দায়দায়িত্ব
তিনিই সামলান। একটা ছেলে। তাঁকে স্কুলে ভর্তি করার সময় টাইমবাবু তার সঙ্গে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া তার পঠনপাঠন, অগ্রগতি, উন্নতি, অবনতি কোনো কিছু লক্ষ্য করার জন্য সময় দিতে পারেননি। দেখা পেলে মাঝে মধ্যে তাঁকে বলতেন, “বাবা, সবকাজ সময়মত করবে, সময়ের অপচয় করবে না—ওটা যথোপযুক্ত কাজে লাগাবে। এখন তোমার ছাত্রজীবন; পড়াশোনাটাই তোমার
একমাত্র ব্রত।”
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গড়িয়ে বৎসরের পর বৎসর চলে যায়। টাইমবাবুর ছেলে হিরার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কমতে থাকে। টাইমবাবুর কাজে
যাওয়ার সময় হিরা থাকে বিছানায় ঘুমিয়ে। রাত্রে ফেরার কিছুক্ষণ
পর খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানা গ্রহণ করার সময় স্ত্রীকে ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করলে উত্তর
পেতেন, “প্রাইভেট ট্যুইশনে
গেছে; আসবেখন।” দীর্ঘদিন এভাবেই চলছিল। বহুদিন পর টাইমবাবু
জানতে পারেন ছেলের অনেক বখাটে বন্ধুবান্ধব ও সাঙ্গোপাঙ্গ। হিরা নাকি তাদের
মধ্যমণি। তাদের কাছে টাইমবাবুর ছেলে হিরা থেকে হিরো। স্বাভাবিকভাবেই
তার লেখাপড়া বেশী এগোয়নি। হিরা বাবাকে এড়িয়ে চলে। সে নাকি বাবার
দায়িত্ববোধকে তাচ্ছিল্য করে বলে, “উনি সময়ের পূজারী; সময় আর সময়ানুবর্তিতার মালা জপতে জপতে মনে হচ্ছে উনি কালজয়ী
হবেন।” হিরার বিশ্বাস যেহেতু তার বাবা নিজের সংসারের প্রতি নজর দেননি
তাই ঐরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবার জন্যই হিরার জীবনটা আজ বিফল। শুধু তার জীবনটা কেন! ওর বিশ্বাস ঐরকম নীতিবাগীশ কর্মী হতে গিয়ে তার মায়ের জীবনটাও বাবাই ব্যর্থ করে ছাড়ল। চাকরীতে দায়িত্ববোধের আতিশয্যে যে লোক পারিবারিক, সামাজিক কোনো কাজে-কর্মে নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকল না—যে কোনদিন মায়ের সুখ-দুঃখ দেখল না—সে আবার বাবা কিসের?
টাইমবাবুর স্ত্রী মালতী অন্য প্রকৃতির। আজীবন কর্মপাগল স্বামীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেননি। তাঁর কোন অনুযোগও ছিল না। তিনি একটু চাপা স্বভাবের। সকাল থেকে সংসারের কাজগুলো যথারীতি করে যেতেন নিঃশব্দে। বিয়ের পর দু-একবার সুখদুঃখের কথা স্বামীকে বলতে গিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন টাইমবাবু মানুষটা অন্য ধাতের। কর্মস্থলের দায়িত্ব পালন করাকেই উনি জীবনের মুখ্য ব্রত বলে বিশ্বাস করেন আর সংসারধর্মটা তাঁর কাছে একেবারেই গৌণ।
টাইমবাবুর কাছে নিজের সংসারের থেকে বিশ্বসংসারের পরিসর আরও বিস্তৃত, আরও গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণের মঙ্গলসাধনের কৃচ্ছ্রসাধনে ব্যক্তি ও পরিবারের কল্যাণ নিহিত। তাই টাইমবাবুর কাজ যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, ওঁর দৃষ্টিতে তা ছিল মানুষের জীবনযাত্রার পথকে সুশৃঙ্খলভাবে সচল রাখার পরিষেবা—যার উনি একজন অতীব সাধারণ কাণ্ডারী। তাই ডিউটির দ্বারা জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নিজের সংসারকে একটু বেশী মাত্রায় উপেক্ষা করে ফেলেছিলেন। সফল মানুষজনের মত সংসারজগত আর কর্মজগতের মধ্যে সমান ভারসাম্য রক্ষা করতে সমর্থ হননি। অথচ টাইমবাবু এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেননি। জগতসংসারে এরকম কিছু মানুষ থাকে যারা কাজপাগল। মুষ্টিমেয় ঐরকম কিছু মানুষের জন্য বিশ্বসংসারের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। আশ্চর্য হতে হয় ঐ লোকেরাই থাকে পাদপ্রদীপের আড়ালে। অবশ্য আমাদের টাইমবাবুর তার জন্য কোন আক্ষেপ নেই। উনি সবার অলক্ষ্যে নিজের দায়িত্ব সুসম্পন্ন করেই তৃপ্ত।
টাইমবাবু সেদিনও যথারীতি ডিপোতে গিয়েছিলেন। দশটার দিকে বাস সিন্ডিকেটের সম্পাদক দুজনকে সঙ্গে করে টাইমবাবুর গুমটিতে আসেন। দু’চার কথার পর সম্পাদক মশায় ইংরাজীতে টাইপ করা একটা চিঠি ওঁর হাতে তুলে দিলেন। পুরোনো দিনের আইএ পড়া টাইমবাবু সেটা পরে অবগত হলেন যে তিনমাস পর আগামী ৩০শে নভেম্বর তাঁর কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার দিন। চিঠিটার মর্ম উদ্ধার করা সত্ত্বেও টাইমবাবুর মধ্যে বাহ্যিক কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। ওনার আশ্চর্যরকম নীরোগ শরীরে প্রতিদিনের মত তখনও প্রশান্তি বিরাজ করছিল।
সিন্ডিকেট কর্তারা আরও জানালেন যে বেশীদিন সময় নেই বলে কাল থেকে একটা ছেলে—অবিনাশ মজুমদার—আপনার কাছে আসবে। তাকে কাজগুলো শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন। সবশেষে তাঁরা একটা কথা বললেন যে সিন্ডিকেটের তরফ থেকে ১লা ডিসেম্বর বেলা দশটায় আপনার বিদায় সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনি নিশ্চয় উপস্থিত থাকবেন।
সব শুনে টাইমবাবু অবিচলভাবে বললেনঃ “অবিনাশ আসবে সে তো ভাল কথা। তাকে
আমি সব বুঝিয়ে শিখিয়ে দেবখন। কোন অসুবিধা হবে না। আর বিদায় সভা করার কী প্রয়োজন
ছিল! না করলেও পারতেন।” সিন্ডিকেট সম্পাদক বিনীতভাবে বললেন, “তা কি হয়! আপনি
যেভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর কাজ করেছেন তাঁর জন্য আপনাকে আমাদের
শ্রদ্ধা নিবেদন করতে বাধা দেবেন না। পয়লা ডিসেম্বর দশটার সময় অবশ্যই উপস্থিত
থাকবেন।” তারপর তাঁরা
নমস্কার বিনিময় করে চলে গেলেন।
পরের দিন টাইমবাবু সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে ছিলেন
অবিনাশের আগমনের আশায়। বহুদিনের কর্মজীবনের সঙ্গী ‘ফেভার ল্যুবা’ টেবিল ঘড়িটায় বার
বার সময় দেখছিলেন অবিনাশের আসার কথা ভাবতে ভাবতে। দুপুর দুটোর পর টাইমবাবুর সামনে
নমস্কার করে দাঁড়াল একটা যুবক। বলল, ‘আমি অবিনাশ’। টাইমবাবু তাকে সাদরে কাছে ডেকে
সেই ছোট্ট কাঠের গুমটির মধ্যে বসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টাইমবাবু অবিনাশকে বললেন,
“বাবা, জীবনে যে কাজই কর তা মনপ্রাণ দিয়ে করবে। আর তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে
বিবেচনা করবে। আমাদের স্টার্টারের কাজে সময়ানুবর্তিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিদিন আগেভাগে ডিপোয় পৌঁছান নিশ্চিত করবে। আরেকটা কথা, কাজের সময় নিজের জায়গা
অর্থাৎ এই গুমটি ছেড়ে কোথাও যাবে না। পরের দিনের বাস চলাচলের সময়সারণীটা আগের দিনে
সময় থাকতে করে রাখবে।” আরও কয়েকটা কাজের কথা অবিনাশকে টাইমবাবু বলতে চেয়েছিলেন
কিন্তু ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেন অবিনাশ বেশ অন্যমনস্ক এমনকি অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সে বলে
উঠল, “ঠিক আছে কাকাবাবু, আপনার কাছে পরে সব শিখে নেবখন। আর এই নগন্য ব্যাপারগুলো
আমি এমনিতেই করতে পারব। কলেজের ডিগ্রীগুলো কি আর আমাকে মুখ দেখে দিয়েছে!”
কথাবার্তা চলাকালীন অবিনাশের মোবাইল বেজে ওঠে। জীন্স
প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে সে কথা বলতে আরম্ভ করল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর
ব্যক্তিগত কথাগুলো টাইমবাবুর কানে আসছিল। যেমন, “হ্যাঁ বল, একটু আমাদের ডিপোয়
এসেছি। দেখ না, আমাদের মেয়র, এম,এল,এ সবাই আমাকে ধরেছে যে এখানের অফিসটা আমাকে
সামলে দিতে হবে। কী আর করি বল? তা তোরা এখন চাঁদুর রেস্টুরেন্টে তো? কী, শেফালী
পৌঁছে গেছে? ঠিক আছে, তোরা অপেক্ষা কর আমি বাচ্চুর বাইকে এখনই যাচ্ছি। তাহলে
ছাড়লাম!!” কথা শেষ হওয়ামাত্র মোবাইল শুদ্ধু হাতদুটো নমস্কারের ভঙ্গিতে তুলে অবিনাশ
টাইমবাবুকে বলল, “কাকু, আজকে আমার একটা আর্জেন্ট মিটিং আছে। আজ যাচ্ছি, আগামীকাল
আসব।” টাইমবাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করে সে চলে গেল।
অবিনাশ ডিপোয় মাঝেমধ্যে ধূমকেতুর মত আসে। সময়ে আসাযাওয়ার
ধার ধারে না। বলে, “এখন তো টাইমবাবু কাজটা চালিয়ে দিচ্ছে; সমস্যার কী আছে?” আর কাজ
শেখার ব্যাপারে ওর মন্তব্যঃ “স্টার্টারের কাজ আবার কোনো কাজ নাকি! ফুহ! তা আবার
শিখতে লাগে?”
অবিনাশ সাধারণত কারও বাইকের পিছনে বসে ডিপোয় আসে।
দু’চারবার নিজেই বাইক চালিয়ে এসেছে। একদিন বাইকের পিছনে একটা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে
এসেছিল। সেদিন ওর চোখে ছিল রোদচশমা। কাঠের গুমটির পাশে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা সিগারেট
ধরিয়ে যেভাবে নির্লজ্জের মত ধোঁয়া ছাড়ছিল তা টাইমবাবুর দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়।
ভাগ্যিস সেদিন অবিনাশ সিগারেটের জ্বলন্ত বড় অংশটা চকচকে জুতো দিয়ে চেপে দিয়ে
বাইকের পিছনে মেয়েটাকে বসিয়ে হাওয়ার বেগে চলে গিয়েছিল তাই টাইমবাবুর অস্বস্তিটা
প্রলম্বিত হয়নি। অন্যদিন অবিনাশ
ডিপোয় আসার পর থেকে দু’চার মিনিট পর
পর তার মোবাইল বেজে ওঠে। তাই তাকে প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং অথবা বিভিন্ন রকম
সমস্যা সমাধান করতে চলে যেতে হয়। টাইমবাবুকে ও থোড়াই কেয়ার করে!!
এইভাবে নভেম্বর মাস অতিক্রান্ত হল। ১লা ডিসেম্বর সকালেও
টাইমবাবু যথারীতি স্নান করে জামাকাপড় পরে ছ’টার পূর্বে ডিপোয় যাওয়ার জন্য বাড়ি
থেকে বের হচ্ছিলেন। স্ত্রী মালতী খাবার জলের বালতি নিয়ে বাইরে থেকে ফেরার সময়
টাইমবাবুকে বের হতে দেখে বললেন, “আজ থেকে তুমি তো অবসরপ্রাপ্ত। এখন তোমার অফিস আর
তোমার নেই। যে কাজের দায়িত্ব এতদিন তোমার ছিল সে তো আর তোমার নয়। এখন কেন ডিপোয়
যাবে? যেতে হবে না।” টাইমবাবু মালতীর কথার যৌক্তিকতা মনে মনে স্বীকার করলেও বললেন,
“তা ঠিক বলেছ! কিন্তু ঐ কমবয়সী অবিনাশের সময়জ্ঞান নেই; তাছাড়া ও নানাবিধ সামাজিক
কাজে এত ব্যস্ত থাকে দেখি যে যাত্রী পরিষেবার কথা ভেবে চিন্তা হয়। ধৈর্যসহকারে ও
সময়ানুযায়ী অবিনাশ সব করতে পারছে কিনা ভাবছিলাম। তাই ভাবলাম ঘরে শুয়ে বসে না থেকে
ডিপোতেই যাই। ওকে একটু সাহায্য করি।”
মালতী চাপা অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন, “না, আজ তুমি এখন ওখানে
যাবে না। ওরা দশটায় বিদায় সভার জন্য ডেকেছে। তখন যাবে। বিয়ের পর থেকে আজীবন কখনো
কোনদিন তোমায় কোন অনুরোধ করিনি—আজকে আমার একটা কথা রাখ। আমার কাছে দুদণ্ড বস। এখন
যেয়ো না।”
টাইমবাবু আজ প্রথম মালতীর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন
না। বারান্দার নড়বড়ে চেয়ারটায় বসে পড়লেন। বহুদিন পর মালতীর মুখটা প্রাণভরে
দেখছিলেন। বাধ্য ছেলের মত ওর কথা আজ টাইমবাবু শুনেছেন দেখে মালতীর মুখটা উজ্জ্বল
দেখাচ্ছিল। আজ মালতী রান্নার বিশাল আয়োজন করেছে। মনপ্রাণ ঢেলে রান্না করতে করতে
মালতী টাইমবাবুর দিকে ফিরে বললেন, “আজ তোমার জন্য মাংস করছি। বহুকাল পর আজ আমরা একসঙ্গে দুপুরের ভাত খাব। সপ্তাহান্তের
ছুটির দিনেও কাজে চলে যেতে; অন্যান্য
পাওনা ছুটির ব্যাপারে তো বলতে ছুটি পাওনা আছে বলে কি অযথা ছুটি নিয়ে বসে থাকতে
হবে? তাই কখনো দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাওয়া হয়নি। আজ যেন আমার কথার অন্যথা না হয়।
বিদায় সভা থেকে যথা সম্ভব শীঘ্র ফিরবে।”
ছোট্ট একটা ‘আচ্ছা’ বলে টাইমবাবু মালতীর অলক্ষ্যে তাকে
দেখতে থাকলেন। আজই প্রথম মনে হল বিয়ের পর মালতীকে যেরকম সুন্দর দেখাত এখন তো আর অত
সুন্দর নেই। মাথার চুলের গোছাটার এখন কী শ্রী হয়েছে! ইতিমধ্যে চুলগুলো ধূসরবর্ণের
কবে হল! টাইমবাবু ভাবলেন এতদিন তো এসব লক্ষ্য করা হয়নি! বড় ভুল হয়ে গেছে। সাতপাঁচ
ভাবতে ভাবতে চেয়ার ছেড়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন। হঠাৎ মনে হল অবিনাশ সব সামলাতে
পারছে তো? টাইমবাবু বুকপকেটে চেন দেওয়া ঘড়িটা একবার বের করে দেখলেন। বাজছে ন’টা।
ডিপোয় যাওয়ার কথা ভাবছিলেন এমন সময় মালতী এককাপ চা নিয়ে হাজির। বললেন, “ধীরে
সুস্থে চা-টা খাও, তারপর ডিপোয় যেও।”
মালতীর আজ আনন্দ ধরে না। টাইমবাবু তাঁর প্রতিটি কথা
রাখছেন। তিনি আবার রান্না
করার জন্য অঘর থেকে চলে গেলেন। এসময় এককাপ চা চিন্টু
প্রতিদিন গুমটিতে দিয়ে যেত। ঐ চা-টা প্রায়শই বিস্বাদ লাগত। মালতীর হাতের তৈরী
আজকেরটা যেন অমৃত মনে হল। চা থেকে চিন্টু আর ডিপোর কথা মনে উদয় হল। তার সঙ্গে
অবিনাশের কথা। ছেলেটা সব সামলাতে পারছে তো? পরিষেবার এই সময়টা সব থেকে বেশী
ব্যস্ততার। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে চারটে রুটের গাড়ি ছাড়ার ব্যাপার থাকে। বুক পকেট
থেকে চেন দেওয়া ঘড়িটা ক্ষিপ্র হাতে বের করে দেখলেন, দশটা বাজতে দশ। নাঃ আর বসে
থাকার সময় নেই। ডিপোর দিকে যাওয়ার জন্য টাইমবাবু উঠে দাঁড়াতে উপলব্ধি করলেন মাথাটা
ঝিমঝিম করছে। ধপাস করে বসতে বাধ্য হলেন। বুকের বাঁদিকটা কীরকম করছে! কী অসহ্য
যন্ত্রণা। ঘাড়ে, কাঁধে যন্ত্রণাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ডিসেম্বরে এত ঘাম কেন! কেন এত
অন্ধকার! বাতাসের অক্সিজেন এত অপ্রতুল!! টাইমবাবু আর কিছু জানেন না। বিছানা থেকে
মেঝেয় পড়ে যাওয়ার আওয়াজে মালতী ঘরের মধ্যে ছুটে এসে দেখেন—সব শেষ। এমন সময় বাইরের
দরজা থেকে হীরার ডাক, “মা দেখ কে এসেছে।” কোনক্রমে মাথা তুলে দেখে দরজার কাছে
হীরার সঙ্গে লাল সাড়িতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে – তার সিঁথিতে সদ্য সিঁদুরের প্রলেপ
থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সদ্য বিবাহিত। মা হীরাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন,
“হীরা তাড়াতাড়ি এঘরে আয়। তোর বাবা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।” ধীর পদক্ষেপে হীরা
ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে বাবাকে মৃত দেখে বলে- “কী কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকরে বাবা ! মরার
আর সময় পেলনা। তোমাকে আজকের দিনেই মরতে হলো !! কী সময়জ্ঞান !!”
ধন্যবাদ স্যার।
ReplyDelete'টাইমবাবু'-র সময়নিষ্ঠতায় অনুপ্রেরণা পেলাম।
প্রকৃত অর্থেই পড়ে খুব ভালো লাগলো।
অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী যা আসবে তার জন্য।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete