আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
(ক)
পূজোর মরসুম। রবিবাসরীয় আমেজ। আহ্লাদী বিকেল। দু'জনে গুটি গুটি পায়ে পৌঁছলাম, আমাদের সেই চেনা গাছটার তলে। পার্ক সার্কাস ময়দানের এই গাছটা আমাদের সব স্বপ্নের সাক্ষী। যাত্রার শুরুয়াতও এখানেই।
মনের ক্যানভাসে স্মৃতির রং-তুলি দিয়ে আঁকতে শুরু করেছি কতশত স্বপ্ন; এমন সময় শাহিন আদুরে কণ্ঠে বলল— চলো না, চা খাবো।
—তুমি তো চা খাওনা !
—তাতে কী হয়েছে। আজ তোমার সাথে খাবো।
আমি নির্বাক; অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে...।
(খ)
পুজোর ছুটি কাটিয়ে সকালেই ফিরেছি। পুজোর মরসুম বলে রিজার্ভেশনেও প্রচণ্ড ভিড় ছিল। সারা রাত প্রায় একরকম জেগে কাটানো। তাই, সকাল থেকেই মাথাটা কেমন ঝিম ধরেছিল। শাহিনের ফোনাফুনিতে বাধ্য হয়ে পৌঁছলাম ময়দানের সেই গাছটার তলে। কোনরকমে। সে পৌঁছেই কপালে হাত ঠেকিয়ে অভিভাবক-স্বরে প্রশ্ন করল— সাহিল, কী হয়েছে?
—আমার না আজ শরীরটা কেমন করছে...!
—কিছু খাবে, আনবো?
—না।
—তাহলে...!
—তুমি এখানেই আমার পাশে একটু বসো!
আমার আদুরে আবদার শুনে সে নির্বাক; অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে...।
(গ)
লাস্ট পাঁচ বছর ধরে বিবিধ কর্মক্ষেত্রে সরকারি নিয়োগে চলছে দোলাচল। চাকরির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে নানান জটিলতা। ফলে, বেকারত্বের দহনে এক এক করে স্বপ্নগুলো পুড়ে ছাই হওয়া শুরু করেছে। তার উপর শাহিনের একগুঁয়ে তর্ক; হয়তো বা ভিন্ন রূপে ভালোবাসারই প্রকাশ। উদ্বেগও বলা যেতে পারে। কারণ, তাঁর জন্য পাত্র দেখার পালা চলছে বেশ জোর কদমে । আমাকে নিয়ে তাঁর যাবতীয় আর্গুমেন্ট মা-বাবার চাহিদার মোকাবেলায় ধোপে টিকেনি। এক ডাক্তারের সাথে তাঁর দিনক্ষণও পাকা করে ফেলেছে বাড়ির লোকেরা। আর এই টানাপোড়েনের মধ্যে শাহিনও হয়ে গেছে কেমন খিটখিটে মেজাজের। দু’জনেই মনে এক রাশ হতাশা নিয়ে দেখা করলাম। ময়দানের সেই গাছটার তলায়। কিছুক্ষণ অসহ্য নীরবতা..., তারপর
এক অদ্ভুদ বিষাদের স্বরে সে বলল— জানো, ট্র্যাজেডিটা কোথায়?
—কোথায়?
—‘এই খানে’, আমার কপালে হাত ছুঁইয়ে— ‘সব এই কপালের দোষ’।
—তাহলে...!
—‘তুমি’ আর ‘আমি’-তেই রয়ে গেলাম। আর ‘আমরা’ হতে পারলাম না...!
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সেখান থেকে চলে গেলো
সে। তাঁর প্রস্থানের এক একটা পদক্ষেপে আমার অস্তিত্বের এক একটা ইট যেন খসে পড়তে লাগল। ধীরে ধীরে মনের গহীন এক অজানা শূন্যতায় ভরে গেল। ‘আমি’ ও ‘আমরা’-র ব্যবধানটা যে এত বিশাল, সেদিনই প্রথম অনুভব করেছিলাম।
(ঘ)
দু’ বছর অতিক্রান্ত হবার পর—
মার্চের এক সন্ধ্যায় কলেজ থেকে ফিরছি। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভাসছে একটা অচেনা নম্বর। একটু বিরক্ত
হয়েই ধরলাম ফোনটা। ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসল একটি অতি চেনা কণ্ঠ— কেমন আছো? এখন কোথায়?
— ... ও শাহিন! হুঁ, ভালোই আছি। এই তো কলেজ থেকে ফিরছি। তুমি?
—আছি কোনোরকম...
—আর তোমার বর?
—আমরা আর এক সঙ্গে থাকি না...
—কেনো! কবে হল এসব?
—ছাড়ো ওসব কথা। কাল তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই। আসবে তো?
হঠাৎ একটা ফোনে আমার জীবন-শৃঙ্খলার বাঁধন টুটে গেল। যত্ন করে গুছানো চিন্তাগুলি তালগোল পাকিয়ে ফেলল। আর সিন্ধান্তের দোলাচল খুবলে খেতে লাগল চিন্তনকে। তবুও আড়ষ্ট পায়ে পৌঁছলাম ময়দানের সে-ই গাছটার কাছে। অবাক হয়ে গেলাম
দেখে- শাহিন আমার আগেই পৌঁছে গেছে
সেখানে। আমার উদ্দেশ্যে আদিখ্যেতা করে বলল— এই তো সাহিল এসে গেছে। এবার হয়তো নৌকো ঘাটে লাগবে...!
—হঠাৎ এমন কী হল...
—ওর আর আমার মধ্যে কোনো কিছুতেই মিল নেই! যেটা...
—তুমি... -অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু এটুকুই বলতে পারলাম- আমার কবিতাতে বেঁচে আছো, তা-ই থাকো।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম দু’জনে।
তারপর উভয়েই হাঁটা দিলাম নিজ নিজ পথে। পাথেয় ছাড়াই। লক্ষ্যহীন এক যাত্রায়...।
No comments:
Post a Comment