ইফতারও যখন
পার্টি...!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
আমি তখন খুব ছোট, ক্লাস টুয়ে পড়ি। প্রথম রোজা রেখেছি সেবার। বড় আব্বু,
মেজো আব্বু, পাড়ার 'দাদা' ও গুণীজনেরা, এমনকি প্রতিবেশী লাল মিয়াঁ থেকে শুরু করে মন্টু শেখ, সকলেই আমাকে রোজা-রমযানের গুরুত্ব
বোঝাতে ব্যস্ত। সেদিনের অত কথা আজ আর মনে নেই। তবে যে কয়েকটা আজও মনের গহীনে গেঁথে
রয়েছে, তার একটি হল- 'আমরা সারাদিন সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে
গরীব-দুঃখী ও অসহায় লোকেদের কষ্ট অনুভব করতে পারি। এ মাসে আমরা যথা সম্ভব দানধ্যান
করি। তাই সিয়ামের সামাজিক গুরুত্ব অপরিসিম...।
কিন্তু, আজ যখন চারিদিকে তাকাই,
রোজার আরও একটি গুরুত্ব আমার মাথায় গিজগিজ করে
যে, এই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আজ আমরা (মুসলমানরা)
কালচারালি অনেক ডেভেলপ করেছি (এবং ক্রমাগত করছি)। আজ সমাজে চারিদিকে প্রতিনিয়ত
ইফতার পার্টির সূর বেজে চলেছে। আর এই পার্টিগুলিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উপস্থিত
হচ্ছেন সকলে, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীও। থাকছে
রকমারি ভজনের আয়োজন। বাহারি ফল ও পানীয়ের। আলোকসজ্জা ও নানান আড়ম্বরতার দীর্ঘ
ফিরিস্তি, আরও কত কিছু...। অভাব শুধু একটি বিষয়ের- যতদূর
আমি অনুভব করেছি, আয়োজনকারী ও অংশগ্রহণকারীদের সদিচ্ছা ও 'তাক্বওয়া'র।
এই পার্টিগুলিতে স্ট্যাটাস-এর নামে অপচয় করাও উন্নত
সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে কখনো। তো কখনো আইটেমের প্রাচুর্যের দরুন ফেলে দিতে বাধ্য হন
অনেকেই। আর এসব অবলীলায় ঘটে চলেছে সেই সমাজে, যাদের একাংশ কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে
শুধু জল ও মুড়ি দিয়ে ইফতার করে। যে দেশে অনেকের সারা মাসে এক কিলো খেজুর কেনার
সামর্থ্য হয় না। যারা সাহরি (ভোরের খাবার) করে দু’মুঠো চাল ফুটিয়ে সঙ্গে একটু ডাল,
কখনো বা একটু আলুমাখা মাত্র। পাঁচপাঁচটি ঈদ
কেটে যায় যাদের কারো দেওয়া একটি পুরাতন কাপড়ে। হ্যাঁ,
যে সমাজে কেউ ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে বিক্রি করে
সম্ভ্রম। যুবতীরা অর্থাভাবে রয়ে যায় পিত্রালয়ে...। আর কবজি পর্যন্ত ডুবিয়ে ইফতার
করি আমরা...!
আচ্ছা, সিয়াম তো একটি ইবাদত (উপাসনা)। নিশ্চয়ই ইফতারও ইবাদত। যদি
তাই হয়, তাহলে ইফতার পার্টি বা ইফতার মজলিস নামে এই অপচয়,
এই আপত্তিকর ট্র্যান্ড বন্ধ করতে কেন ফাতওয়া দেন না 'আমপারা পড়া হামবড়া'-র দল, যারা একটি নফল বা সুন্নতকে নিয়ে পরস্পরের কোপালে এঁকে দেয়
কুফরির চিহ্ন...!
আর একটি কথা, লাস্ট ইয়ার আমি একটি ইফতার পার্টিতে গিয়েছিলাম,
সেখানে আমার পাশের টেবিলে বসে ‘ইফতার’ করছিলেন
এক বোন। যুবতী। ভদ্র। ওয়েল-কালচারড। ছিলেন স্লিভ্লেস পরে, আর পোশাক প্রয়োজনের
তুলনায় একটু বেশিই স্বচ্ছ ছিল...। (কে কীরকম পোশাক পরবে, তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তা বলে স্থান-কাল-পাত্রের খেয়াল রাখবো না, তা হয় না।) 'ইফতার পার্টি' বলছি শুনে অনেকের পিত্তি জ্বলছে। কিন্তু একবার
ভাববেন, বুকে হাত রেখে, গভীর ভাবে- এগুলো ইফতার, না শুধুই পার্টি? নাকি ভালো খাবারের একটি সুযোগ?
না গেট টুগেদারের একটি মাধ্যম মাত্র...?
ধিক ধিক শতধিক ‘তাক্বওয়া’ বর্জিত এই সাধনাকে এবং এর
পৃষ্ঠপোষকদেরকে।
২৮/০৫/২০১৭
তপ্সিয়া,কলকাতা
একটি কলেজে, ইংরেজি বিভাগের ইফতার মজলিস |
No comments:
Post a Comment