Thursday 24 November 2016

লেসানুদ্দীন ইবনুল খাতীব


লেসানুদ্দীন ইব্‌নুল্‌ খ়াতীব
(১৩১৩ – ১৩৭৪ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
জন্ম ও পরিচয়ঃ
আরব তথা সারা বিশ্বের ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইব্‌নুল্‌ খ়াতীব একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি সমসাময়িক যুগে স্পেনের শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিক ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ, উপাধি লেসানদ্দীন। পিতার নাম ‘আব্দুল্লাহ, পিতামহের নাম সা‘য়ীদ। কিন্তু তিনি সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন ইব্‌নুল্‌ খ়াতীব নামে। তিনি ৭১৩ হিজরি মোতাবেক ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের গ্রানাডায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা জন্মসূত্রে সিরীয়। তবে তারা পরবর্তীতে স্পেনে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন।
 
শিক্ষা ও জীবনঃ
৭৪১ হিজরীতে তাঁর পিতা – তিনি তখন গ্রানাডার মন্ত্রী ছিলেন – মারা গেলে সরকার তাঁর অতিরিক্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। এই রকম এক চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লেসানুদ্দীন দমে না গিয়ে তাঁর পঠন পাঠন চালিয়ে যান এবং যথেষ্ট উন্নতি করেন। তিনি সেখানকার বিদ্বজনেদের নিকট ভাষা, দর্শন, ইতিহাস, চিকিৎসা, ধর্মীয় প্রভৃতি শিক্ষা অর্জন করেন। এবং সমকালীন স্পেনীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন।
 
কর্মজীবনঃ
তাঁর শিক্ষা, মেধা ও খ্যাতি তৎকালীন গ্রানাডার শাসক আবুল্‌ হাজ্জাজ ইউসুফের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তাঁকে মন্ত্রী পদে বরণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র পঞ্চম মুহাম্মাদের সময়ও তাঁকে সেই পদেই বহাল রাখা হয়। উল্লেখ্য যে, দুটি মন্ত্রীসভা পাওয়ার কারণে তাঁকে জুল্‌ ওয়াযারাতাইন (দুই মন্ত্রিত্বের অধিকারী) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
 
মৃত্যুঃ
তাঁর উত্তরোত্তর উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত কিছু সভাসদ বাদশাহকে তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করলে বাদশাহ তাঁকে কারারুদ্ধ করেন। সেখানেই ৭৭৬ হিজরীতে মোতাবেক ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। ঐতিহাসিক আহ্‌মাদ হাসান যাইয়াতের মতে, দর্শনতত্ত্বে যুক্ত থাকার জন্য ফেকাহবিদদের একটি দল তাঁর প্রতি নাস্তিকতার তকমা লাগায়। ফলে তাঁকে কারা বরণ করতে হয়। এবং কারাগারেই তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
 
প্রতিভাঃ
জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। ইতিহাস শাস্ত্রে খ্যাতি অর্জন করলেও কবিতা রচনাতেও তিনি সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। ঐতিহাসিক জুরজী যাইদানের মতে, তিনি ইতিহাস, দর্শন, গণিত, চিকিৎসা ও ফিক্‌হ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। প্রশাসনিক জীবনের নানা ব্যস্ততা ও শত উত্থান পতনেও তাঁর কলম কখনোও থেমে থাকেনি। শতাধিক ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিয়মিত লিখে গেছেন, সময়ের ফাঁকে ফাঁকে মূল্যবান সাহিত্য কর্মকাণ্ড রেখে গেছেন উত্তরসূরিদের জন্য।  
 
বৈশিষ্টঃ
গদ্য রচনাতেও ছন্দময়তা তাঁর সহজাত বিষয় ছিল। তাঁর সাবলীল সৃজনশীলতা, জ্ঞানের যে কোনও ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণকে অবাধ করেছে। যদিও তাঁর কিছু কিছু রচনায় অতিরঞ্জন লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কবিতায় সূক্ষ্ম শব্দের সমাহার হলেও অর্থ ছিল স্পষ্ট। শিক্ষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ তাঁর যুগে তাঁর কাছে গিয়ে শেষ হয়ে যায়, খানিকটা ইব্‌নু খালদুনের ন্যায়। এ মর্মে যাইয়াত মন্তব্য করেছেন, যেমনটা আফ্রিকাতে সাহিত্য ও জ্ঞানের চূড়ান্ত পর্যায় ইব্‌নু খালদুনকে ছুঁয়ে পূর্ণতা লাভ করে ঠিক তেমনই স্পেনে তাঁরই সমকালীন ইব্‌নুল্‌ খাতীবকে স্পর্শ করে চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছয়। তবে তাঁর অবদান সর্বাধিক ইতিহাস শাস্ত্রে। এমনকি এই বিষয়ে তাঁর পুস্তকের সংখ্যা ষাটটিরও বেশী।  
 
রচনাবলীঃ
নিঃসন্দেহে তাঁর লেখনী আরবী জ্ঞানভাণ্ডারকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর অতি মূল্যবান সাহিত্য সম্পদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হলো— কিতাবুল্‌ ইহাতাহ্‌ ফী তারিখে গার্‌নাতাহ্‌, আল্‌-হুলালুল্‌ মার্‌কূমাহ্‌, মান্‌ফা‘আতুস্‌ সাইল ফিল্‌ মারাদিল্‌ হাইল, দীওয়ানু শে’র। তাঁর কাব্য প্রতিভার বহু নিদর্শন এই সংকলনে রয়েছে। তিনি কবি ইব্‌নু সুহাইলের মুওয়াশ্‌শাহের প্রতিউত্তরে রচিত নিজ মুওয়াশ্‌শাহ কবিতাটিতে বলেছেন—  
جادك الغيث إذا الغيث همي     يا زمان الوصل بالأندلس
لم يكن وصلك إلا حلما     في الكرى أو خلسة المختلس

No comments:

Post a Comment