আব্দুল মাতিন
ওয়াসিম
থার্টিফার্স্ট-নাইট
আজ। বিশ্বজুড়ে চলছে প্রস্তুতি বেশ জোর কদমে বছরের এই শেষ রাতটিকে মোহময় করে তোলার।
কেউ কেউ আবার সর্বস্ব ব্যয় করে হলেও স্মরণীয় করে রাখতে চায় এই মহেন্দ্রক্ষণকে। তাই
চারিদিকে আজ উৎসবের আমেজ। নানা রঙের আলোয় স্নাত হবে আজ রাজপথ থেকে গলিপথ; নানা
ভাবে, নানা রূপে সেজে উঠবে পার্কস্ট্রিটের বার থেকে চৌমাথার ঠেক-সবই।
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের এই রীতি সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার। তবে ১লা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে ধার্য
হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর; পোপ গ্রেগরির নামানুসারে যে ক্যালেন্ডার। প্রকৃতপক্ষে, এই
নববর্ষ উদযাপন রীতি ইরানের ‘নওরোজ’ উৎসব হতে অনুপ্রাণিত, যা পুরনো বছরের শেষ
বুধবার থেকে নতুন বছরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত উদযাপিত হয়। আর এই নওরোজের প্রবর্তন করেছিলেন প্রাচীন পারস্যের এক পরাক্রমশালী সম্রাট জমশিদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে। এই নববর্ষ বিভিন্ন সভ্যতায়
বিভিন্ন সময়ে উদযাপিত হতো; যেমন- মেসোপটেমিয়ায় ‘আকুতি’, শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যাবিলনে মহাবিষুবের দিনে ২০
মার্চে। অ্যাসিরিয়াতে জলবিষূবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বরে। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারস্যের একাংশে ২১ সেপ্টেম্বরে। গ্রীসে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বরে। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকানুযায়ী ১ মার্চে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১
জানুয়ারিতে। ইহুদিদের নিকট এই ‘রোস-হাসানা’ তৃতীয় মাসের (যা
মোটামুটিভাবে ৫ সেপ্টেম্বর
থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত) দ্বিতীয় দিনে,
কিন্তু কট্টরপন্থী ইহুদিদের নিকট উক্ত মাসের প্রথম দিনে। আর মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নতুন বছর আরম্ভ হতো ২৫শে
মার্চ।
তাঁদের ধারণা- এদিন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল মাতা মেরির কাছে যিশু খ্রিস্টের
জন্মবার্তা জ্ঞাপন করেছিলেন। তবে অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫
ডিসেম্বর। ভারতবর্ষে ইংরেজ আমলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হলেও রাজস্ব
আদায় ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলা সাল ‘ফসলী সন’ অধিক প্রচলিত
ছিল, যা সম্রাট আকবরের আদেশে আমির ফতহুল্লাহ শিরাজি উদ্ভাবন করেন এবং ১০ই মার্চ
১৫৬৩ সালে চালু হয়। তাই বাংলা জুড়ে বর্ষবরণ পালিত হতো পহেলা বৈশাখে।
বর্ষবরণের সাথে ধর্মীয় যোগসূত্রটিও প্রাচীন। পূর্বে বর্ষবরণকে ধর্মীয় আচার বলে
বিশ্বাসও করা হতো। এমনকি অগ্নি উপাসকরা এখনো বর্ষবরণকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে করেন। এখনো ফসলী সনের নববর্ষ হিন্দুদের নিকট একটি ধর্মীয় উৎসব; আগের
দিনটি চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখ হলো ঘট পূজার দিন। তবে, বর্তমানে বর্ষবরণ
অনুষ্ঠান বা থার্টিফার্স্ট-নাইট বা থার্টিওয়ান এন্ড ফার্স্ট-নাইট উৎসবের নামে বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক
আগ্রাসনের একটি সুচিন্তিত কৌশল। ‘বিশেষ দিবস’ উদযাপনের মোড়কে
যুবক- যুবতীদের চরিত্র
হননের একটি অপচেষ্টা বৈ আর কিছুই নয়; যা সম্পূর্ণরূপে সফলও। আর এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বড় শিকার বিশ্বব্যাপী যুবসমাজ। থার্টিফার্স্ট নাইট,
ভ্যালেন্টাইন’স ডে,
এপ্রিল ফুল- এর মতো বিভিন্ন নামে বছরজুড়ে যেসব উৎসব পালন করা হয়, তাতে আমরা বাঙালিরাও বেশ অগ্রণী। ঐ যে কথায় আছে,
উদযাপনের জন্য বাঙালির উৎসব দরকার।
এধরণের উৎসবে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা ও নগ্নতার বাজার যে বেশ উষ্ণ
থাকে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অপসংস্কৃতিগুলি ভোগবাদী পশ্চিমাদের থেকেই আমদানিকৃত। ‘থার্টিফার্স্ট-নাইট’
নামে এই ইংরেজি নববর্ষ বরণ-উৎসব এখন বিশ্বের
প্রায় সব দেশেই বেশ আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয়ে চলেছে। পশ্চিমা বিশ্বের এই কিশলয়টি
বিশ্বায়নের ঘাড়ে চেপে বিশ্বের আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে নিজ ডালপালা ছড়িয়ে
একটি বিশাল মহীরুহের রূপ ধারণ করে ফেলেছে।
দেখা গেছে- ইংরেজি
নববর্ষকে বরণ করে নেয়ার জন্য ৩১ ডিসেম্বর রাত
১২টা ১ মিনিট থেকে শেষ
রাত অবধি থাকে নানা ধরনের আয়োজন। এই রাতে বল্গাহীন আনন্দে
গা ভাসাতে যুবক-যুবতীরা রাস্তায় নেমে একে অপরকে
জড়িয়ে
ধরে। উদ্দাম নৃত্য, নাইটক্লাবে নগ্ন
ড্যান্স,
মদিরা পান সহ
নানা অসামাজিক ও অশ্লীল কাজ সংস্কৃতির নামে চলে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত। এমনকি
কপোত-কপোতির মাঝে চলে দীর্ঘ-চুম্বনের কঠিন প্রতিযোগিতা। ব্যাপক
হৈ-হুল্লোড়, নানান তালের বাদ্য-বাজনা ও চোখ-ধাঁধানো
আলোকসজ্জার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। ফেসবুক,
হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে একে অপরকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাতে বিন্দু মাত্র
বিলম্ব অসহনীয় হয়ে ওঠে। আর হোটেল, পতিতালয়, পানশালা, নাচঘর, ক্লাবঘর, নাইটক্লাব সেজে উঠে নতুন সাজে; যেন করজোড়ে ডাক দিয়ে চলেছে— ‘চলে এস মোর ভুবনে, মেতে উঠ নব
আনন্দে’।
কিন্তু এই
উদযাপন, এই উন্মাদনা যে নানা রূপে বহু মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়, তা কি
অস্বীকার করা জো কারও আছে? মাত্রা-ছাড়ানো আওয়াজের কারণে মরণাপন্ন হয় বহু হৃদ-রোগী,
বেপরোয়া ড্রাইভিঙ কেড়ে নেয় কারও বসবাসের শেষ সম্বল, তো কারও প্রাণ। আবার কারও
জীবনে ধর্ষণের ন্যায় অভিশাপ ডেকে আনে এই উৎসব। উদযাপন করতে গিয়ে কারো ডিস্টার্ব হলো
কিনা এসবের কোনো
তোয়াক্কা করা হয় না; ঘুম-অসুস্থতা কোন কিছুরই
না।
যে উৎসব কেড়ে
নেয় কারো সতীত্ব, কারো ঘুম, কারো স্বস্তি, আর যা-ই হোক কোনো ভালো ও সভ্য
সমাজের উৎসব হতে পারে না- আমার ধারণা। কারণ, কোনো সভ্য
ব্যক্তি কখনই অন্যের অধিকার
নষ্ট করে নিজের
সুখ মেটাতে পারে
না। বরং একজন সচেতন নাগরিক ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে বছর শেষে আমাদের
প্রত্যেকের আত্মপক্ষ সমালোচনা করা উচিৎ, সঙ্গে অনুশোচনাও যে, একটি বছর কীভাবে
অতিক্রান্ত হল,
অজান্তে কতগুলো
ভুল করে ফেললাম, ভালো কাজ বেশি করলাম
না মন্দ কাজ? পাশাপাশি, মনে
মনে আগামী দিনে দেশ ও দশের স্বার্থে গঠনমূলক কাজ করার দৃঢ় সংকল্প
করাও জরুরি। আর এও ভেবে দেখা দরকার যে, নির্ধারিত জীবন
থেকে অতিক্রান্ত হল একটি বসন্ত; আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম
মৃত্যুর দিকে। আর মৃত্যুর
কাছাকাছি এসে কীভাবে এমন আনন্দে
মেতে ওঠা যায়? সর্বোপরি, আমরা বাঙালি, আমরা
ভারতীয়। আমাদের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আছে নিজস্ব
সভ্যতা, উৎসব, রীতিনীতি। আর আমাদেরকেই
সেই সংস্কৃতিকে লালন করতে হবে। বিশ্বের দরবারে আমাদেরকেই তুলে
ধরতে হবে নিজেদের উৎসব-ইতিহাস, রীতিনীতি ইত্যাদি। তা নাহলে যে আমাদের বহু-চর্চিত
দেশপ্রেম মুখ থুবড়ে পড়বে।
(প্রকাশিত-
সম্পাদকীয় পাতা, পূবের কলম, ৩১-১২-২০১৬)
Zaazakallah
ReplyDeleteVery nice sir.....skillful and helpful bayan.which help our nation's futurs
ReplyDelete