Friday 21 December 2018

যুহায়ের বিন আবু সুল্‌মা

যুহায়ের বিন আবু সুল্‌মা

(৫২৫-৬০৯ খ্রিঃ)

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

 

পরিচিতি ও জন্মঃ

মু’আল্লাকা কবিগোষ্ঠীর এক অনন্য ও উল্যেখযোগ্য নাম কবি যুহায়েরের। তাঁর কবিতায় জ্ঞান ও দর্শনের আধিক্যকে প্রত্যক্ষ করে ঐতিহাসিকরা তাঁকে আশ্‌-শা’য়েরুল্‌ হ়াকীম (প্রজ্ঞাময় কবি) উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আরবি সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি একমাত্র কবি, যার পুরো পরিবার কাব্য সাধক ছিল। নাম যুহায়ের, পিতার নাম রাবী’আহ্‌, উপনাম আবু সুল্‌মা, পিতামহের নাম রেবাহ়। মাতা ছিলেন জ়ুব্‌ইয়ান গোত্রের বিখ্যাত জাহেলী কবি বাশামাহ্‌ বিন্‌ আল্‌-গ়াদীর-এর ভাগ্নি। কবি যুহায়ের নাজদ প্রদেশের হ়াজিয নামক স্থানে মুযাইনাহ্‌ গোত্রের প্রায় ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পুরো পরিবার কাব্যসাধনায় মগ্ন ছিল। তাঁর পিতা, মামা, ভগ্নীদ্বয় ও পুত্রদ্বয় সকলেই কবি ছিলেন।

 

বাল্যজীবনঃ

তিনি বাশামাহ্‌ বিন্‌ আল্‌-গ়াদীর-এর ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত হন। ফলে তাঁর জ্ঞান, অভিমত, কাব্য ও অভিজ্ঞতা হতে অনেক কিছুর শিক্ষা লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মাতা প্রখ্যাত জাহেলী কবি আউস বিন্‌ হুজ্‌র-এর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কবি আউস তাঁকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন, তাই তাঁকে নিজের রাবী (বর্ণনাকারী) নিযুক্ত করেন

 

বৈবাহিক জীবনঃ

কবি সর্ব প্রথম উম্মে আওফ়া নামক এক মহিলাকে বিয়ে করেন, যার প্রকৃত নাম অনেকের মতে লায়লা ছিল। তার থেকে অনেকগুলো সন্তান জন্মলাভ করেছিল, কিন্তু সকলেই শিশু অবস্থায় মৃত্যু বরন করে। যেহেতু কবিও আর পাঁচটা মানুষের মতো সন্তানের জন্য লালায়িত ছিলেন, তাই তাকে তালাক দিয়ে কাব্‌শাহ্‌ বিন্‌তু ‘আম্মার-কে বিয়ে করেন এবং তার থেকে কা’আব, বুজায়ের ও সালিম নামের তিনটি সন্তান লাভ করেন। তবে তাঁদের মধ্যে সালিম শিশুবেলায় মারা যায়। আর বাকি দু’জন পরবর্তীতে বিখ্যাত কবি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু কাব্‌শাহ্‌ ছিল ভোঁতা মাথার, তাঁর উপর অমিতব্যয়ী; তাই বিশ বছর পর কবি আবার উম্মে আওফাকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে রাজি হয়নি। সেজন্যই কবি তাঁর বহু কবিতায় উম্মে আওফার উল্লেখ করে নিজ মনের কথা তুলে ধরেছেন। এমনকি তাঁর বিখ্যাত মু’আল্লাকার সূচনা উম্মে আওফার বাস্তুভিটার স্মৃতিচারণা দিয়ে করেছেন।  

 

নবী(সাঃ)- সাক্ষাতের বাসনাঃ

ইব্‌নুল্‌ আসীর ও ইব্‌নু হাজার বলেন কবি আহ্‌লে কিতাবদের (ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের) সঙ্গে মিশতেন। তাঁদের কাছ থেকে শেষ নবীর আবির্ভাবের কথা জানতে পারেন। সেই থেকে আন্তরিক ভাবে তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করতেন। কিন্তু ব্যর্থ  হন। নবীর (সাঃ) আবির্ভাবের এক বছর পূর্বেই ইহলোক ত্যাগ করেন।

 

অসিয়ত ও পরলোকগমনঃ 

একদা তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, আকাশ থেকে একটা সিঁড়ি নেমে এসেছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে তিনি তা ধরতে পারলেন না। তিনি বুঝে গেলেন। তাই সন্তানদের নিকট দুঃখ প্রকাশ করে তাঁদেরকে অসিয়ত করলেন যে, তাঁরা যদি সাক্ষাৎ লাভ করে, তাঁরা যেন অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করে। এই বিদগ্ধ মনীষা কবি যুহায়ের নবুয়তের এক বছর পূর্বে ৬০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৯০ বছরে উপনীত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

 

কাব্য প্রতিভাঃ

তিনি জাহেলী কবিদের প্রথম স্তরের একজন প্রতিভাধর কবি। অনেকে তাঁকে অন্য দু’জন প্রথম স্তরীয় কবি ইম্‌রাউল কায়েস ও নাবিগাহ্‌-এর উপর প্রাধান্য দিয়েছে, তাঁর সুন্দর-সাবলীল চিত্রায়ন ও অকৃত্রিম বর্ণনাশৈলীর কারণে। ঐতিহাসিকদের ধারণা, তিনি চারমাসে একটি কবিতা রচনা করতেন, পরবর্তী চারমাসে নিজেই তার সংযোজন ও বিয়োজন করতেন। অতঃপর পরবর্তী চারমাসে পরিমার্জনার জন্য কবি মনীষাদের নিকট তা উপস্থাপন করতেন। প্রায় এক বছর সময় নিয়ে তাঁর রচিত কবিতাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসতেন। আর তাই তাঁর এ ধরণের কবিতাগুলি হ়াওলিয়াত (বাৎসরিক কবিতা) নামে পরিচিত।

 

কাব্যিক বৈশিষ্টাবলীঃ

তিনি অপরিচিত শব্দ, অতিরঞ্জন ও অস্পষ্টতা থেকে দূরে থাকতেন। প্রেমাবেগ তাড়িত সঙ্গীত ও গুণগান বর্ণনায় এবং সৌন্দর্যের চিত্রায়নে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর কবিতায় প্রাঞ্জল ভাষা ও মধুর সঙ্গীতের সূরের যোজনা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কবিতাসমূহ যেন তাঁর সত্যবাদিতার প্রতিচ্ছবি।

 

মু’আল্লাকা রচনাঃ

তিনি তাঁর মু’আল্লাকায় আল্‌-হারিস বিন্‌ ‘আউফ ও হারাম বিন্‌ সিনান-এর চরম প্রশংসা করেছেন। কেননা এই দুই নেতা দীর্ঘ দাহ়িস ওয়াল্‌ গ়াব্‌রা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধরত ‘আবাস ও জ়ুব্‌ইয়ান গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সন্ধির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে তিনিও জাহেলী প্রথানুসারে প্রেমিকার বাস্তুভিটার স্মৃতিচারণার মাধ্যমে নিজ মু’আল্লাকার সূচনা করেছেন।

 

কবিতার নমুনাঃ

তিনি হারেস ও হারেমের প্রশংসায় বলেছেন—

আমি শপথ করে বলতে পারি সুখে দুঃখে সর্ব অবস্থায় তোমাদের মধ্যে দু’জন মহান নেতাকে পাওয়া গেছে।[1]

 

তিনি যুদ্ধের অপকারিতার চিত্রায়ন সুনিপুণ ভাবে করেছেন—

যখন তোমরা তাকে উস্কানি দাও, নিন্দনীয়ভাবেই তা করো, যখন তোমরা তার আগুন জ্বালিয়ে দাও, তা জ্বলে ওঠে আর সব কিছু পুড়িয়ে দেয়।

যাঁতা কলের নীচে যেমন চামড়া পিষ্ট হয়, তা তোমাদেরকে অনুরূপভাবে পিষ্ট করে দেবে, প্রসবের পরক্ষনেই তা পুনরায় গর্ভ ধারণ করবে এবং যমজ সন্তান প্রসব করবে।[2]

 

তিনি জীবন সম্বন্ধে নিজ অভিজ্ঞতাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন—

যুবকের জিহ্বা (ভাষা) হচ্ছে অর্ধেক, বাকি অর্ধেক তাঁর হৃদয় (ভাবনা); এ দুটো ছাড়া যুবক (মানুষ) হচ্ছে মাংস ও রক্তের একটা পুতলা।[3]

 

আর সৌন্দরয্যের চিত্রায়ন তিনি এভাবে করেছেন—

তাঁদের মধ্যে বিনোদন রয়েছে প্রত্যেক দর্শনেচ্ছু ব্যাক্তির জন্য আর প্রত্যেক নিরীক্ষণকারী দর্শক চক্ষুর জন্য মনোরম দৃশ্য।[4] 



[1]

يميناً لنعم السيدان وُجدتما     على كل حال من سحيل ومبرم

[2]

متى تبعثوها تبعثوها ذميمة     وتضرّ إذ ضربتموها فتضرم

فتعرككم عرك الرحا بثفالها     وتلفح كشافا ثم تحمل فتتئم

[3]

لسان الفتى نصف ونصف فؤاده     فلم يبق إلا صورة اللحم والدم

[4]

وفيهن ملهى للصديق ومنظر     أنيق لعين الناظر المتوسّم

No comments:

Post a Comment