Wednesday 19 December 2018

মোহাম্মদ মসিহুর রহমানঃ কুরআন-শিক্ষা ও বিজ্ঞান-চর্চা করতে হবে একই সঙ্গে


কুরআন-শিক্ষা ও বিজ্ঞান-চর্চা করতে হবে একই সঙ্গে


                          মোহাম্মদ মসিহুর রহমান  
অধ্যাপক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

ইতিহাস অনুপ্রেরণা দেয়। সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় সমাজকে। আত্মসমিক্ষার আহ্বান জানায়। আর এই ইতিহাসের সূত্র ধরে আমরা যখন পৌঁছে যাই মধ্য যুগের আব্বাসি শাসনামলে (৭৫০-১২৫৮ খ্রি) দেখতে পাই, খাওয়ারিযমি (আলজেবরা), ইবনুল-হাইসাম (অপটিক্স), ইবনু সিনা (মেডিসিন), ইবনু রুশদ (দর্শন), আর-রাযি (কিমিয়া), জাবির ইবনু হাইয়ান (কেমিস্ট্রি), ইবনু নাফিস (এনাটমি) প্রমুখ মনীষাদের। যারা ইসলামী শরিয়তের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শিতার পাশাপাশি সফল বিজ্ঞান সাধক ছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আমরা বর্তমান সময়ে নিজেদের অবস্থান লক্ষ করি দেখতে পাই, সে-যুগে এযুগের মুসলিম সমাজে প্রশান্ত মহাসাগরের ন্যায় এক সুবিশাল ব্যবধান জীবন-যাপনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে।
একদা আমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেবায়, আবিষ্কারে, সমাজ সেবায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এমনকি ইউরোপীয় রেনেসাঁয় আমাদের ভূমিকাও বেশ প্রশংসনীয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের এই পশ্চাদপদতা কেন? কিভাবে আমরা হারিয়ে ফেললাম সেই যুগান্তকারী গৌরব-গাথার স্রোত।
আমার ধারণা, আমরা সে-যুগে সফল হয়ে ছিলাম, কারণ সে-সময়ে আমরা জ্ঞানকে বিভাজিত করিনি। কুরআন-শিক্ষা বিজ্ঞানচর্চাকে একসঙ্গে বহন করতে পেরেছিলাম। যেই সমন্বয় বর্তমানে কোথাও দেখা যায় না। হয়তো আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ এই বিভাজনই। বোধ করি, জ্ঞান সম্পর্কে প্রকৃত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সকলের নিকট স্পষ্ট করে তোলা উচিৎ।    
বিজ্ঞানকে আরবিতে ইলম বলা হয় আর ইলম হল বিষয়সমূহের বাস্তবতার পরিচয় লাভ করা ইসলাম জ্ঞান পরস্পরের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ জ্ঞান ব্যতীত ইসলাম অসম্পূর্ণ ইসলাম ব্যতীত জ্ঞান অসম্পূর্ণ সহজ করে বললে, প্রভুর পরিচিতি ছাড়া উপাসনার কী অর্থ? আর উপাসনা বিনা জ্ঞানেরই বা লাভ?
নিখিল বিশ্ব আল্লা অসীম ক্ষমতার প্রকাশিত রূপ আল্লা পরিচিতি লাভ হয় তাঁর গুনাবলীর প্রকাশিত রূপের মাধ্যমে মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ, জড়, পৃথিবী, আকাশ, নক্ষত্ররাজি, গ্রহসমূহ, স্থলভাগ, জলভাগ, শূন্যমার্গ, বায়ু, অগ্নি, জল ইত্যাদি প্রতিটি মানুষকে বিশেষ করে মুসলমানদেরকে এই মহাকাশ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানাচ্ছে আর নিজের গতিবিধির মাধ্যমে প্রকাশ করছে যে, তাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা মনুষ্য জাতিকে স্রষ্টা পর্যন্ত পৌঁছতে সাহায্য করে। বোধ করি সেখ সাদী যথার্থই বলেছেনঃবিবেকবানব্যক্তির জন্য উদ্ভিদের প্রত্যেকটি পাতা সৃষ্টিকর্তাকে  চেনার জন্য একটি গ্রন্থের মত কাজ করে
কোরআনে ৭৫৬টি আয়াতে বিশ্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে আল্লাহ্তায়ালা কিছু কিছু জায়গায় প্রকৃতির দৃশ্যাবলীর প্রতি আমাদেরকে বিচার-বিবেচনা, অধ্যয়ন অনুসন্ধান করতে আহ্বান করেছেন
মহাকাশ তাঁর মূল তথ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান পর্যবেক্ষণ করাকে বিজ্ঞান বলে ইসলাম বিজ্ঞান দুটি পৃথক নৌকার যাত্রী নয়, বরং দুটি একই নৌকার অবিচ্ছেদ্য আরোহী এমনকি উভয়ই একটি চরম সত্যের দুটি পৃথক নাম
কুরআন সকল ব্যক্তিদের জ্ঞানী, বিবেকবান বিদ্বান বলে আখ্যায়িত করেছে, যারা কুরআনের আলোকে সৃষ্টিকুল বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে। যদি বাচনিক নিদর্শন (কুরআনের আয়াত)-এর উপর চিন্তাভাবনা করা কুরআনিক চিন্তাভবনা হয় তাহলে প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর চিন্তাভাবনাকে যেখানে বিজ্ঞান বলা হয় সেটিও কুরআনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তা নাহলে বিষয়রূপে বিশ্বসৃষ্টি আর জমাটবদ্ধ রক্ত হতে মনুষ্য সৃষ্টির আলোচনা দিয়ে ওহীর সূচনা হতো না। এই সত্যটিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিরা বিজ্ঞানকে পার্থিব জগতের জ্ঞান মনে করে তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেনি। অথচ কুরআনের আহ্বান- “তুমি কি দেখোনা, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা আমি বিভিন্ন বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি। পর্বতসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের গিরিপথ সাদা, লাল নিকষ কালো; অনুরূপভাবে বিভিন্ন বর্ণের মানুষ, জন্তু চতুষ্পদ প্রাণী রয়েছে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী দয়াময়। [সূরা ফাতির ২৭-২৮]
আর মর্মে স্যার সাইয়েদ আহমাদ খান-এর মন্তব্যটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, কুরআন হল আল্লাহর কথা আর বিশ্বজগৎ তাঁর কর্ম
আমার ধারণা, বর্তমানে বিজ্ঞান জগতে মুসলিমদের অনগ্রসরতার মূল কারণ হল কুরআন হতে বিমুখ হওয়া। আমাদের সমাজে অধিকাংশ বাড়িতে কুরআনকে গেলাফে মুড়ে আলমারি বা বুক-শেল্ফে অলংকার রূপে রাখা হয়। মাদ্রাসাগুলির পাঠ্যক্রমে সেটির প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা হয় না যে সমস্ত আধুনিক প্রতিষ্ঠানে ধর্মতত্ত্ব পড়ান হয়, সেগুলিতে তা মসলা-মাসায়েল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আর এভাবেই যখন থেকে আমরা শিক্ষাপদ্ধতিতে কুরআনকে গুরুত্বহীন করে নিয়েছি তখন থেকে ক্ষমতা ঐশ্বর্য আমাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
ইসলাম একটি বিশ্বব্যাপী জীবন ব্যবস্থা আর কোরআন একটি সর্বকালীন বিধান কোরআনের অলৌকিকতা এই যে প্রত্যেক যুগের সমস্যা-সমাধানের পূর্ণযোগ্যতা তাঁর মধ্যে রয়েছে সুতরাং প্রত্যেক ুগে তা সম্পূর্ণরূপে সমুজ্জ্বল ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রীক দর্শনের উত্থান ঘটে, তখন সেই দর্শনের নিরিখে জ্ঞানের স্তর বিন্যাস করা হত পরবর্তীতে ধর্মতাত্ত্বিকরাও দর্শন শিখলো কিন্তু তারা কোরআনের প্রতি সন্দেহের কোন সুযোগ পেলো না কারণ, কোরআন দর্শন যুক্তির নিরিখে সম্পূর্ণরূপে অনন্য। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ আজ মানু বিজ্ঞানের আলোকে নিজ জিজ্ঞাসার উত্তর কামনা করে আর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণাদির আলোকে সকল জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা নিবারণে কোরআন সম্পূর্ণরূপে সক্ষম শুধু প্রয়োজন বিচার-বিবেচনা করার আর কোরআনকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করার
বলা বাহুল্য, কোরআন ইসলামকে আধুনিক পদ্ধতিতে উপস্থাপনের দায়িত্বটা ইসলামী বিদ্বানদের এবং ধর্মীয় শিক্ষার মূলকেন্দ্র মাদ্রাসাগুলির কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে গড্ডলিকা প্রবাহ এমন চরম আকার ধারণ করে ছে যে, তার দূর হওয়ার কোন নাম গন্ধই পাওয়া যায় না গবেষণামূলক কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ কতিপয় পুস্তক কিছু মনীষীর মতামত আর কোরআন হাদীসের আক্ষরিক অনুবাদের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয় এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে এমনকি কতিপয় মনীষীদের ব্যাখ্যা অভিমতকে অন্তিম নির্ণায়ক ধারণ করা ধরণের কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শুধু বরকত অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে হাদীস শুধু পাঠ করা হয়  সেখানে বিচার-বিবেচনা, প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, তর্ক-যুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি শব্দগুলি অর্থহীন এমনকি ইজতেহাদ বা উদ্ভাবনের দ্বারকে রুদ্ধ করে বিচার-বিবেচনা হতে ধর্মতত্ত্বের ছাত্রদেরকে সম্পূর্ণরূপে বিমুখ করে দেওয়া চ্ছে
পক্ষান্তরে, বর্তমানে মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিতমিশনবাআকাদেমিশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিতে জোরালো ভাবে বিজ্ঞান চর্চা অব্যাহত থাকলেও, ধর্মতত্ত্ব পাঠদানের কোন প্রশংসনীয় পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠানেদ্বিনিয়াত’-এর মোড়কে কতিপয় মসলা-মাসায়েল শিখনের প্রয়াস করা হচ্ছে; কিন্তু কোথাও ধর্মীয় রীতিনীতিগুলীর আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেগুলির বাস্তবায়নের কোন আলোচনা বা তর্কবিতর্ক প্রায় শূন্যের ঘরে।
বোধ করি, সময় এসেছে এবার এসবের পরিবর্তন করার। আর এই পরিবর্তনে আমাদের সকলকে অংশ নিতে হবে। আমাদের সবাইকে উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার এই বিভাজনকে সমাপ্ত করতে হবে যাতে করে পরবর্তী প্রজন্মকে অর্ধ মুসলিম বা অর্ধ মানুষ নয় বরং সম্পূর্ণ মুসলিম তৈরি করতে পারি; এমন এক পূর্ণ মানুষ যে দেশ-দশ-জাতি-ধর্ম সকলের সেবায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণে সক্ষম হবে।  

[পূবের কলম, ৬ই জুন, ২০১৭-এর উত্তর সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত] 

No comments:

Post a Comment