Wednesday 5 December 2018

জীবন ও কর্মের আলোকে ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী

জীবন ও কর্মের আলোকে ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

ভারতবর্ষে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার-প্রসারে যাদের অবদান অনস্বীকার্য ড. মুক্তাদা হাসান আযহারী তাদের অন্যতম তিনি এক বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন রচনা, সম্পাদনা, অনুবাদ, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা ইত্যাদির মাধ্যমে আজীবন দেশ ও দশের সেবা করে গেছেন।

                                                

বাল্যজীবনঃ

৮ই আগষ্ট ১৯৩৯ সালে উত্তর প্রদেশের মৌনাথভঞ্জন (মৌ) নামক এক ছোট শহরে তাঁর জন্ম পিতা মুহাম্মাদ ইয়াসীন একজন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী ছিলেন স্থানীয় দারুল উলূম মাদরাসায় কুরআন মাজীদ পাঠের মাধ্যমে শিক্ষা জীবনের সূচনা এই বিদ্যানিকেতনেই সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করতঃ তাজবীদ’-এর জ্ঞান লাভ করেন। অতঃপর ক্রমান্বয়ে সেই শহরের জামে আলিয়া আরাবিয়া’, জামেআ ইসলামিয়া ফায়যে আম  জামেআ আসারিয়া দারুল হাদীস’-এ শিক্ষা অর্জন করেন। এর পাশাপাশি উত্তর প্রদেশ মাদরাসা বোর্ড থেকে প্রথম বিভাগে মৌলভী ও আলিম এবং দ্বিতীয় বিভাগে ফাযিল পাশ করেন


পিরামিডের দেশেঃ  

উচ্চশিক্ষা লাভের বাসনা নিয়ে ১৯৬৩ সালে মিসর পাড়ি দেন। বিশ্ববন্দিত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব অনুষদ থেকে ১৯৬৬ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর নবাব সিদ্দীক হাসান খানঃ  জীবনী ও অবদান বিষয়ে পিএইচ ডি-তে রেজিস্ট্রেশন করান। কিন্তু, ১৯৬৭ সালে গবেষণার কাজ অসমাপ্ত রেখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তিনি কায়রো রেডিও’-র উর্দূ বিভাগে অনুবাদক ও প্রচারক হিসাবে দু বছর চাকরি করেছিলেন


মানুষ গড়ার কারিগররূপেঃ  

দেশে ফিরে ১৯৬৮ সালে বেনারসের বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামেআ সালাফিয়ায় আরবী ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি ছিলেন প্রকৃতার্থেই মানুষ গড়ার শিল্পী নিজ অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই বলছি, আমার দীর্ঘ শিক্ষা জীবনে অনেক স্বনামধন্য শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি; তবে এ অবধি তাঁর দোসর আমি খুঁজে পাইনি। ১৯৮৭ সালে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের রেক্টর নিযুক্ত হন অতঃপর ২০০৫ সাল থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদে আসীন ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি  অগ্রগতিতে তাঁর অবদান সর্বজনবিদিত

শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৭২ সালে এম ফিল এবং ১৯৭৫ সালে আরবী ভাষা ও সাহিত্যে পিএইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ইবনু আব্দিল বার্-এর বাহজাতুল মাজালিস গ্রন্থের তাহকীক্ব


পত্রিকা সম্পাদনাঃ 

জামেআ সালাফিয়ায় পঠনপাঠন শুরু হয় ১৯৬৩ সালে অতঃপর ১৯৬৯ সালে একটি আরবী পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আযহারী সাহেব এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিযুক্ত হন।  প্রথমতঃ পত্রিকাটি সাওতুল জামে’ (জামেআর মুখপত্র) নামে প্রকাশিত হত। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সাওতুল জামেআ আস-সালাফিয়া’ (জামেআ সালাফিয়ার মুখপত্র) তারপর সাওতুল উম্মাহ’ (জাতির মুখপত্র) বর্তমানে শেষোক্ত নামেই সেটি প্রকাশিত হচ্ছে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত এর সম্পাদক ছিলেন এই পত্রিকায় লেখা সম্পাদকীয়গুলি আরবী ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অপরিসীম দখলের পরিচয় বহন করে। বলাবাহুল্য, ভারত বর্ষে আরবী ভাষার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন

শিক্ষকতা ও সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি জামেআ সালাফিয়ার প্রেস ও ইসলামী গবেষণা এবং ফাতওয়া বিভাগের পরিচালকরূপেও কাজ করেছেন।


সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণঃ 

তিনি দেশ-বিদেশের বহু সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮০-র ডিসেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠিত সীরাতুন্নবী সম্মেলনে শরীআতের দ্বিতীয় উৎস হাদীস বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।এছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি প্রভৃতি দেশের বহু সেমিনারে তিনি অংশগ্রহণ করেন।  

২০০৬- ২৯ ও ৩০শে এপ্রিল নবাব সিদ্দীক হাসান খান- জীবনী  ও অবদান শীর্ষক একটি দুদিনব্যাপী সেমিনার বেনারসের জামেআ সালাফিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে বিশিষ্ট ইসলামী বিদ্বান ও অধ্যাপকগণ নবাব সিদ্দীক হাসান খানের জীবনী ও কর্ম সম্পর্কিত বহুল তথ্যে সমৃদ্ধ ২৯টি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এই সেমিনারে ড. আযহারী সাহেব সেমিনারের গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য পেশ করেছিলেন।

সর্বভারতীয় আহলে হাদিস সংগঠন (মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীস হিন্দ) -এর উদ্যোগে ২০০৮ সালের অক্টোবরে দিল্লীতে একটি ঐতিহাসিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উদ্বোধনী ভাষণ তিনিই দিয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৮০ সালে জামেআ সালাফিয়ায় দাওয়াত ও শিক্ষা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আয়োজন করা হয়। এই সেমিনারে দেশ-বিদেশের বহু স্বনামধন্য ইসলামী বিদ্বান ও গবেষক অংশগ্রহণ করেছিলেন। উক্ত সেমিনারটিকে সফল করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিভিন্নভাবে আজীবন সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত ছিলেন।  


পরলোকগমনঃ

আরবী সাহিত্যের এই একনিষ্ঠ সেবক ও উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ২০০৯ সালের ৩০ অক্টোবর সহস্র অনুগামী ও ভক্তদের শোকসাগরে ভাসিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন (মহান আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতি করুণা বর্ষণ করুণ)।  


আরবী ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অবদানঃ

আরবী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আসক্তি ও আকর্ষণ অবর্ণনীয় জামেআ সালাফিয়াতে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। তারীখে আদাবে আরবী (আরবী সাহিত্যের ইতিহাস) শিরোনামে উর্দূতে আরবী সাহিত্যের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন

এছাড়া তিনি দিকপাল আরবী সাহিত্যিক আববাস মাহমূদ আল-আক্কাদের আত্মজীবনী আনা’ (আমি)-এর উর্দূ অনুবাদ করেনউক্ত বইটি জামেআ সালাফিয়া থেকে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। মানসূরুল-ফাকিহী : হায়াতুহু ওয়া শিরুহু শিরোনামে আলীগড় ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত মাজাল্লাতুল মাজমা আল-ইলমী আল-হিন্দী’-তে তিনি আরবীতে একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় উর্দু ভাষায় আধুনিক আরবী কবিতার পথিকৃত মাহমূদ সামী আল-বারূদী’, শাওকী ও তাঁর কবিতা’, ‘হাফিয ইবরাহীম একজন জাতীয়তাবাদী মিসরীয় কবি’, ‘ইবনু কুতায়বার জীবনী  অবদান’, ‘উমাইয়া যুগের গীতিকাব্য চর্চা প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে আরবী সাহিত্যে অনস্বীকার্য অবদান রাখেন


রচনাবলীঃ 

মৌলিক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি তিনি উর্দূ ও ফার্সী থেকে আরবীতে এবং আরবী থেকে উর্দূতে অনেক মূল্যবান গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হল--

ক) আরবী থেকে উর্দূতে অনূদিত গ্রন্থাবলীঃ 

) শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের মুখতাসার যাদুল মাআদ  

) সিরিয়ার ইসলামী বিদ্বান জামালুদ্দীন কাসেমী রচিত ইসলাহুল মাসাজিদ 

) তালখীস ওয়া তারজামা ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া। 

) আব্দুল হালীম য়াইস এর ফী যিলালির রাসূল এর অনুবাদ রিসালাত কে সায়ে মেঁ শিরোনামে 

) আব্দুল হালীম য়াইস-এরই সুকূতু সালাসীনা দাওলাহ


খ) উর্দূ  ফার্সী হতে আরবীতে অনূদিত গ্রন্থাবলীঃ 

) কাযী সুলাইমান মানসূরপুরী রচিত রাহমাতুল্লিল আলামীন 

) ঐতিহাসিক গোলাম রসূল মেহের রচিত সারগুযাশত-ই-মুজাহিদীন’-এর অনুবাদ তারীখুল মুজাহিদীন নামে 

) মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফীর  হারাকাতুল ইনতিলাকিল ফিকরী ওয়া জুহূদুশ শাহ অলিউল্লাহ আদ-দেহলভী শিরোনামে 

) শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী রচিত কুররাতুল আইনাইন ফী তাফযীলিশ শায়খাইন গ্রন্থটি ফার্সী থেকে আরবীতে অনুবাদ করেন। উক্ত বইয়ে উল্লেখিত হাদীস ও আসারগুলির তিনি তাহক্বীক্ব ও তাখরীজও করেন। 

) শাহ সাহেবের ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতিল খুলাফা শীর্ষক আরও একটি ফারসী গ্রন্থের আরবী অনুবাদ করেন 

) মুহাম্মাদ ইসমাঈল সালাফী রচিত মাসআলাতু হায়াতিল আম্বিয়া উর্দূ থেকে আরবীতে ভাষান্তরিত করেন 

) তাকী আল-আমীনীর আল-ইসলামু তাশকীলুন জাদীদ লিল হাযারাহ 

) তাকী আল-আমীনীর বায়নাল ইনসান আত-ত্বাবীয়ী ওয়াল ইনসান আস-সিনায়ী 

) তাকী আল-আমীনীর  আসরুল ইলহাদ: খালফিয়্যাতুহু আত-তারীখিয়্যাহ ওয়া বিদায়াতু নিহায়াতিহি 

১০) তাকী আল-আমীনীর আস-সুনানুর-রাববানিয়্যাহ ফী রুকিয়্যিল উমাম ওয়া ইনহিত্বাত্বিহা


মৌলিক রচনাঃ 

) খাতূনে ইসলাম (উর্দূ)। 

) তাখরীজু আহাদীসে বাহজাতুল মাজালিস 

৩) তারিখে আরবী আদাব (উর্দু)।   

তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে জ্ঞান সাধনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। জামেআ সালাফিয়ার অগ্রগতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে তাঁর আত্মত্যাগ, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে তাঁর অবদান এবং ভারত সহ বহির্বিশ্বে এর প্রচার ও প্রসারে তিনি যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা সত্যিই অনস্বীকার্য ও ঈর্ষণীয়। 

 

 [দৈনিক পূবের কলম, ১৭-০২-২০১৭ দ্বীন-দুনিয়াতে প্রকাশিত]


No comments:

Post a Comment