Monday 31 December 2018

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ বাবা, এখন আমায় আর কেউ বকেনা...!



বাবা, এখন আমায় আর কেউ বকেনা...!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

বাবা!
অনেক দিন হয়ে গেল, তোমার সাথে আমার দেখা নেই। কথাও হয়নি বহুদিন।জানো, এখন আমি আগের থেকে অনেক বেশি উশৃঙ্খল, অনেক বেশি দুরন্ত।আচ্ছা বাবা, তোমার মনে পড়ে, আমার ছেলেবেলার দুরন্তপনার সেসব কথা, পাড়ার দক্ষিণ প্রান্তের সেই তেঁতুল গাছটার কথা? রোজ বিকেলে সেই গাছটায় উঠতাম। লাফ মেরে এ-ডাল থেকে সে-ডালে যেতাম।বাদুড়ের মতো উল্টো হয়ে ঝুলে থাকতাম কোনো সরু ডালে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।খবর পেয়ে ছুটে আসতে তুমি, হাঁপাতে হাঁপাতে।ছড়ি দেখিয়ে, শাসিয়ে, নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে আমায়

ক্লাস টুতে পড়ার সময় একবার নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলাম।বেশি দূরে নয়, পাশের তুলাই নদীতে। যে-নদীটা আমাদের প্রাইমারী স্কুলের গা-ঘেঁষে, মিয়াঁদের আম বাগানের আঁচল ছুঁয়ে নাচতে নাচতে গিয়ে মিশেছে টাঙনের বুকে।মেজদা খুব মেরেছিল সেদিন। পা ধরে ছুড়ে দিয়েছিল পুকুরের মাঝে।যখন এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুড়ছি, ডুবে যাচ্ছি প্রায়, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হালি দি।কোলে করে তুলে নিয়ে গেছিল পাড়ে। তুমিও বকেছিলে। মনে আছে তোমার সেসব কথা!

মাগরিবের আযান হলে, তুমি আমায় সঙ্গে করে মসজিদে নিয়ে যেতে।সেদিনও বলেছিলে। কিন্তু আমি যাইনি। ফুটবল খেলছিলাম।খেলতে গিয়ে কীভাবে বুড়ো আঙুলটা ভেঙে গেছিল সেদিন, মনে নেই সে-কথা।তবে এখনো মনে আছে, সারা রাত মা  তুমি ঘুমোওনি।আমার ব্যথায় কাতর মুখটি দেখে সেবার তুমি কিছুই বলোনি আমায়।একবার বাম হাতটাও ভেঙেছিল, চৌকি থেকে পড়ে গিয়ে!

গ্রামের আর পাঁচটা ছেলের মতোই, আমিও সারা পাড়া চষে বেড়াতাম।পুন্যা দীঘির পাঁকে মাছ ধরতাম। এর-ওর গাছে ঢিল ছুড়তাম। আম-জাম-কুল কত কিছু পেড়ে, পকেটে জমিয়ে, চিবোতে চিবোতে গ্রাম-মাঠ-দীঘি এফোঁড় ওফোঁড় করতাম। বেসুরো কণ্ঠে গান-গযল-সূরা-আযান যা মনে আসত বিড়বিড় করতাম।তবে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে, পাড়ার ছেলেদের সাথে বেশিক্ষণ খেলা করলে, দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিলে, দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে, তুমি আমায় দ্রুত বাড়ি ডেকে আনতে।সর্বক্ষণ আগলে রাখতে। তোমার মনে পড়ে সেসব কথা!

বাবা, বাঁশকুড়ি-কদমডাঙ্গা-চণ্ডীপুর-মহিপালের সেই চেনা পরিসর ছাড়িয়ে এখন আমি থাকি এক অচেনা শহরে; কলকাতাতে। এখানে রাস্তাঘাটে, অলিগলিতে অনেক চায়ের দোকান। বেশ জমজমাটে ভিড়ও থাকে সে-সব দোকানকে ঘিরে। মাঝে মাঝে সেই ভিড়ের উপর এক আধবার নজর বুলাই, যদি দেখা পাই! তবে, এখানে চায়ের দোকানে বসে কেউই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয় না। এখানে সবাই ছোটে, যে যার মতো; কেউ কাজে তো কেউ কাজের খোঁজে। 

এখানে চারপাশে অনেক গাছপালা। ঠিক আমাদের গ্রামটার মতো। আম-জাম-কাঁঠাল সব গাছ আছে
; এমনকি তালগাছও আছে এখানে। তবে এখানকার গাছগুলো কংক্রিটের তৈরি। ডালপালাগুলো কাঁচ-টিন-ফাইবারের। কিছু কিছু জায়গায় সেসব ডালপালা থেকে ফল-ফুল-রসও পড়ে। বলতে পারো এটা একটা জঙ্গল; কংক্রিটের। এই জঙ্গলেও গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, হায়েনা, হাতি, হরিণ সবই আছে। মানুষও আছে; তবে তাঁরা সংখ্যায় কম!      
  
সারাদিন ছুটে বেড়াই। চেতনা-অবচেতনার আলোয়ানে নিজেকে মুড়ে, চাকরি-দায়িত্ব-স্বপ্ন-বাসনার বোঁচকা পীঠে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তুলি তিলোত্তমার বুক  পীঠ।সময় মতো খাইনা। ঘুমাইনা। পড়াশুনাটাও আগের মতো করিনা।বড্ড বেশি রোগা হয়ে গেছি ইদানীং। কিন্তু, এখন আমায় আর কেউ বকেনা, বাবা। বড়দা-মেজদা কেউ না, মা না!




No comments:

Post a Comment